চিত্র প্রদর্শনী চলছে। দশ জন তরুণ উদীয়মান আর্টিস্টের অঙ্কিত ছবির প্রদর্শনী।
শিল্পকলা একাডেমীর হলরুমে ছবিগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে। দেশ বরেণ্য লেখক, শিল্পী এবং ব্যক্তিত্বরা এসেছেন প্রদর্শনী দেখতে। সাধারন মানুষও এসেছেন।
করোনার কারনে দীর্ঘদিন ধরে বিনোদনের সকল উৎস বন্ধ। মানুষ এই বদ্ধ অবস্থায় ক্লান্ত। তাই করোনা চলে যাওয়ার পরবর্তী এই চিত্র প্রদর্শনীর নাম দেয়া হয়েছে- মুক্ত বাতাসে আবার মেলেছি ডানা।
হ্যাঁ, করোনা বিদায় নিয়েছে। যেভাবে হুট করে এসেছিল, সেভাবে হুট করে বিদায় নিয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আবার ফিরে এসেছে।
তাই শিল্পকলা একাডেমী আয়োজন করেছে দশজন প্রতিভাবান তরুণের করোনাকালীন অঙ্কিত চিত্রের প্রদর্শনী। মানুষের ভিড় দেখে বোঝা যাচ্ছে তাদের আয়োজন সফল।
হলরুমটাতে দক্ষিণ পাশের দেয়ালে ভিড় বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে পরিণতি নামক ছবিটার দিকে মানুষের আগ্রহ বেশি। সবাই ঘুরে ঘুরে খালি ছবিটার দিকে যাচ্ছে। কেমন একটা ঘোর লাগা ব্যাপার আছে ছবিটার।
অনেকেই ইনফরমেশন ডেস্কে জানতে চাচ্ছেন- এটার আর্টিস্ট কে? নিচে ছোট্ট করে যে সিগনেচার আছে, সেটা পড়া যায় না। ইনফর্মেশন ডেস্কের মেয়েটা জানাচ্ছে, চিত্রটা এঁকেছেন তরুণ চিত্রশিল্পী পার্থ।
কেউ জানে না, এই হলরুমের এক কোনায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করছে পার্থ। যদিও নিজের চিত্রের প্রতি মানুষের এরকম আগ্রহ দেখে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু পার্থ নিস্পৃহভাবে তাকিয়ে আছে। সকাল থেকে একটানা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। মানুষের আগ্রহ দেখছে।
এখন যে মেয়েটির ইনফর্মেশন ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার আগ্রহ অন্যদের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম বলে মনে হচ্ছে। সে ছবিটা কিনতে চাচ্ছে। পার্থ মেয়েটির কথোপকথন শোনার জন্য আরেকটু এগিয়ে গেল। অন্য দিকে তাকানোর ভান করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো মেয়েটির কথোপকথন।
-ছবিটি আমি কিনতে চাই।
-সরি ম্যাডাম। এটি শুধু প্রদর্শনীর জন্য। বিক্রির জন্য নয়।
-কিন্তু আমার ছবিটি লাগবেই।
-আমি আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারছি না।
মেয়েটির যেন কিছুটা হতাশ। সে তবুও শেষ চেষ্টা করছিল।
-তাহলে আর্টিস্টের কন্টাক্ট নাম্বারটা দিন। আমি যোগাযোগ করি।
-আমরা বড়জোর আপনাকে এটুকু বলতে পারি, এটি আর্টিস্ট পার্থ রয় এঁকেছেন। এর বেশি কোন তথ্য আমাদের ইনফরমেশন ডেস্কে নেই।
-তাকে আমি কোথায় পাব?
-সেটি বলতে পারছি না, সরি।
-কিন্তু আমার যে ছবিটা লাগবে?
-সরি ম্যাম।
পার্থ একটু অবাক হল। তারা আঁকা একটা ছবির জন্য এতটা অধীর আগ্রহ কারো হতে পারে, তার জানা ছিল না।
পার্থ একটু এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে বলল, ম্যাডাম একটু কথা বলতে পারি?
মেয়েটির চোখ তুলে তাকালো। তার চোখে এখনো আর্টিস্টের কন্টাক্ট নাম্বার না পাওয়ার হতাশা অনেকটা অমনোযোগী ভাবেই মেয়েটি বলল, কি বলবেন আপনি?
-কেন ছবিটা নিয়ে আপনার এত আগ্রহ জন্মেছে?
-দেখুন এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। আপনি কেন এটা নিয়ে প্রশ্ন করছেন?
-জাস্ট কৌতুহল। বললে হয়তো আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি।
মেয়েটি যেন একটু আশার আলো খুঁজে পেল। তার চোখ ঝিলিক মেরে উঠল। বলল, আপনি কিভাবে সহযোগিতা করবেন আমাকে?
পার্থ তার কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনের ব্যাগ দেখিয়ে বলল, আমিও একজন আর্টিস্ট।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বলল, আপনি আমাকে এই ছবিটির আর্টিস্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন? এই ছবিটা আমার দরকার।
পার্থ বলল, সেটা করতে পারি। কিন্তু তার আগে আমাকে জানতে হবে, আপনি কেন ছবিটি প্রতি এত আগ্রহী?
মেয়েটা একটু যেন দ্বিধান্বিত। আমতা আমতা করে বলল, ছবিটা সুন্দর দেখতে। ভালো লাগতে পারে না?
পার্থ মুচকি হাসলো, ভালো লাগা আর অতিরিক্ত মুগ্ধতার মধ্যে পার্থক্য আছে ম্যাডাম। আপনি অতিরিক্ত মুগ্ধ ছবিটির প্রতি। এরকম উদগ্রীব কেন, সেটাই জানতে চাচ্ছি?
মেয়েটির যেন কিছুটা ধৈর্যচ্যুত হল। একটু তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, দেখুন। আপনি যদি চান আমাকে সহযোগিতা করতে, তাহলে আর্টিস্টের নাম্বারটি অথবা কন্টাক্ট ইনফো দিতে পারেন। কিন্তু পার্সোনাল বিষয়ে কোন প্রশ্ন করার অধিকার আপনার নেই।
পার্থ বুঝল, এভাবে কাজ হবে না। তাই সে একটু অন্য পথে চেষ্টা করল। বলল, এই ছবিটি এঁকেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগের সাবেক ছাত্র পার্থ রয়। আমি তাকে চিনি। আপনি যদি সত্যি কথাটা বলেন, তাহলে আমি তার কন্টাক্ট ইনফো দিতে পারি। কারণ একজন আর্টিস্টের কন্টাক্ট নাম্বার দেওয়াটা অনুচিত। তবু আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি, যদি আমি সত্যি কারণটা জানতে পারি।
মেয়েটি বুঝতে পারল- এভাবে কাজ হবে না। তাকে সত্যিটাই বলতে হবে। সে ডানে বামে তাকিয়ে তারপর বলল, আসুন আমরা কফি লাউঞ্জে গিয়ে কথা বলি।
পার্থ অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের কফি কখন যে জুড়িয়ে গেছে, তাদের দুজনে কেউ সেটা খেয়াল করে নি।
পার্থ বিশ্বাসই করতে পারছে না, এরকম একটা ঘটনা তার সাথে ঘটতে পারে!
মেয়েটির চোখে এখনো জল টলমল করছে। পার্থ সে দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। তার খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটিকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। রক্ত বলে কথা!
মেয়েটা কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিল। একটা টিস্যুর কোনা দিয়ে চোখ মুছলো। তার মনে হল, এতটা ইমোশনাল হয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না।
সে আবার বলতে শুরু করল, হয়তো এটা কাকতালীয়। এরকম তো হতেই পারে। অথবা মাকে রিসেন্টলি হারিয়েছি বলেই হয়তো ছবির মহিলাটিকে মায়ের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি বারবার তাকিয়ে দেখেছি। শুধু আমার মায়ের মুখে দেখতে পেয়েছি ছবিটাতে। যদিও বয়স অনেক কম মনে হচ্ছিল মহিলাটির। যেন আমার মায়ের বিশ-পঁচিশ বছর আগের ছবি।
বলতে বলতে হঠাৎ মেয়েটি পার্থর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, একি আপনার চোখে জল কেন?
পার্থ তার অশ্রু গোপন করতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ঝড় করে কেঁদে দিল। এবং মেয়েটির দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।
পার্থ ছোটবেলায় তার মাকে হারিয়েছে। হারিয়েছে বলতে- একটা মারাত্মক ভুল বুঝাবুঝির কারণে তাদের বাবা-মায়ের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
তাকে বড় হতে হয়েছে বাবার কাছে। তার বাবা ছিলেন একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। এমনকি সে তার দাদাবাড়ির খবরও কিছুই জানে না। তার বাবা তাকে কখনো সেগুলো বলেনি।
মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতেন না। শুধু বলতেন, বড় হও। তারপর তোমাকে একদিন তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবো।
কিন্তু সে বড় হতে হতে তার বাবা মরে যান। একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় উনার মৃত্যু হয়। তার কাছে মায়ের কেবল একটাই ছবি ছিল। বাবা মায়ের বিয়ের ছবি। যে ছবিটা অনেক ব্যবহারে মলিন হয়ে গেছে। এছাড়া মা কিংবা তার পরিবারের কোন স্মৃতিচিহ্ন তার জানা ছিল না।
পার্থ যখনই কোন ছবি আঁকতে যায়, মায়ের মুখ আকার সময় তার সেই মলিন ছবিটার কথা মনে পড়ে যায়। এই কারণেই করোনায় আক্রান্ত মৃত মায়ের লাশ কোলে নিয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের সামনে একটি বালক.. সেই ছবিটা যখন এঁকেছিল পরিণতি শিরোনামে, সেখানেও মায়ের ছবি ভেসে উঠেছে।
আর সেই ছবি দেখে তার বোন আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। কারণ সে তার মায়ের আবছায়া দেখতে পেয়েছে ছবিটিতে। যে কিনা মাত্র এক মাস আগে সত্যি সত্যি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন!
বি:দ্র: গল্পের সবগুলো চরিত্র যদিও কাল্পনিক, তবে আমাদের বিডি কমিউনিটির একজন সক্রিয় সদস্য এবং অসম্ভব প্রতিভাবান শিল্পী @artistparthoroy থেকে প্রধান চরিত্রটির নাম নিয়েছি। এটা শুধুমাত্র উনার অসম্ভব সুন্দর সৃষ্টিকর্মগুলোর প্রতি আমার মুগ্ধতা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ভালবাসার একটা ছোট্ট উপহার..
আত্মকথনঃ
আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।
- Hive: My Blog
- LeoFinance: My Leo
- Dtube: My Tube
- 3speak: My Vlog
- Twitter: My Tweet
- FB: My Profile
- Pinmapple: My Tour
- TravelFeed: My Feed
"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"
জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি