কবিতার পুনর্পাঠ: বিদ্রোহী কবিতা এবং বাঙালি মনস্তত্ত্ব

in BDCommunity4 years ago

images 6.jpeg

বাঙালি জাতির জন্য একটা দুর্ভাগ্য তাদের অসীম রত্ন ভান্ডার.. এদেশের মাটি এত বেশি উর্বর যে.. প্রাচীন কাল হতে এদেশ সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা।

আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছের গল্প.. একটা সময় সত্যিই এমন ছিল.. কিন্তু একটা প্রবাদ আছে- আপনা মাংসে হরিণা বৈরী.. নিজস্ব সম্পদ কখনো কখনো নিজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়.. ঠিক এই অঞ্চলের জন্য তাই হয়েছে।

এই সম্পদের কারণে বিভিন্ন বণিক এবং দস্যুদের নজরে বারবার পড়েছে এই বাংলা.. অনেকেই এখানে ব্যবসা করতে এসেছে.. অনেক এসেছে লুটতরাজ করতে।

আবার যারা ব্যবসা করতে এসেছিল.. তারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব গ্রহণ কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। এর কারণে মগ, বর্গী, ফিরিঙ্গি, ব্রিটিশ, পর্তুগিজ সহ অসংখ্য বিদেশিদের দ্বারা নিষ্পেষিত হয়েছে বাংলা।

শত শত বছর ধরে আমরা পরাধীন ছিলাম.. আর দীর্ঘদিন পরাধীন থাকার কারণে আমাদের মনমানসিকতায় দাসত্ব এবং আনুগত্য বাসা বেধেছে..

কিন্তু মানবমনের স্বতঃস্ফূর্ত বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ.. তাই স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ আমাদের মনের মনিকোঠায় লুকায়িত ছিল শত শত বছর ধরে.. আমরা সেটা ব্যক্ত করতে পারি নি- কখনো উপনিবেশিকতার কবলে পরে.. আবার কখনও রাজা-জমিদারদের নিষ্পেষণে পড়ে।

ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেষ দিকে যখন কবি নজরুলের আবির্ভাব হলো.. তখন আমাদের সেই অব্যক্ত লালিত অনুভূতি তার কবিতায় খুঁজে পেলাম.. বিশেষ করে বিদ্রোহী কবিতাটিতে। এজন্যই এই কবিতাটি এত জনপ্রিয়.. এই কবিতাটি হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের মুক্তি এবং সংগ্রামের প্রতীক।

বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর -
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!

(বিদ্রোহী: অগ্নিবীণা, কাজী নজরুল ইসলাম)

images 7.jpeg

এই কবিতা যখন কেউ শোনে.. কিংবা পাঠ করে.. আপন মনে বলে উঠে- বল বীর, চির উন্নত মম শির.. তখন তার ভেতর সেই শত শত বৎসরের নিগৃহীত হওয়ার বেদনা গুমড়ে ওঠে.. এবং চাপা দেয়া স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে.. তখন কবির ভাষাকে নিজের মনের ভাষা মনে হয়..

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বির, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!

(বিদ্রোহী: অগ্নিবীণা, কাজী নজরুল ইসলাম)

আমরা চিৎকার করে কবিতাটি পাঠ করি.. আমাদের ভেতরে যত ক্ষোভ, যত অপ্রাপ্তি এবং যত সঞ্চিত যন্ত্রণা.. সব উগড়ে দিই শব্দের শিহরণে। এজন্যে বিদ্রোহী কবিতাটি এত বেশি জনপ্রিয়.. এত বেশি আমাদের জীবন ঘনিষ্ঠ।

আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!

(বিদ্রোহী: অগ্নিবীণা, কাজী নজরুল ইসলাম)

আমরা নিষ্পেষিত হই.. নিগৃহীত হই.. বেদনায় মুহ্যমান হই.. কিন্তু কখনো মুখের হাসি ছাড়ি না। আগুনে বসে হাসতে জানি.. বেদনা এবং ঘৃণার মধ্যেও ভালবাসতে জানি-
images 9.jpeg

আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

(বিদ্রোহী: অগ্নিবীণা, কাজী নজরুল ইসলাম)

সবশেষে আমাদের ভেতরের সেই দুর্মর আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে.. লড়াই-এর বাসনা এবং হার না মানা চির বিদ্রোহী চেতনা আমরা লালন করি, ধারণ করি.. এবং কবির সাথে সুর মিলিয়ে আবৃত্তি করি-

মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না -
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

(বিদ্রোহী: অগ্নিবীণা, কাজী নজরুল ইসলাম)

images 1.jpeg