রক্ত মাংসের এই দেহ খানা নাকি মাটির তৈরী, বড়ই রহস্যময় বিধাতার সৃষ্ট এই মানব জাতি। তার চেয়ে বড় রহস্যজনক বিষয়টা কি জানেন মাটির তৈরী সেই মানব জাতি আজকে মাটির পাত্রে আহার করতে কেন সংকোচবোধ করেন। পোঁড়া মাটির পাত্রে আহার করলে, সত্যিই কি আমাদের কপাল পুঁড়ে যাবে নাকি না অন্যকারন। সভ্যতার আধুনিকায়ন কি আমাদের রুচি পরিবর্তন করে আমাদেরকে সভ্য রুচি দান করেছেন? বর্তমান সভ্যতার সাধারন জীবন যাপন আর বিলাসবহুল জীবন যাপন যেখানেই দৃষ্টিপাত করুন না কেন, পরিবারে চোখ ধাধাঁনো অল্পনা করা সিরামিক, মেলামাইন কিংবা কাঁচের প্লেট, বাটি এবং গ্লাস না থাকাটা আমাদের কাছে খুবই লজ্জাজনক একটা বিষয়। সেখানে মাটির তৈরী পাত্র আমাদের কাছে সত্যিই গ্রহনযোগ্যহীন একটি বস্তু।
আরে ভাই, আমাদেরকে কি পাগলা কুত্তায় কামাড়াইছে যে, আমারা মাটির পাত্রে আহার করব। দেখতে কেমন বিশ্রী, কদাচিত এবং স্বাস্থ্য সম্মত নয়। আমাদের টাকা আছে, আমরা কেন মাটির পাত্রে ভাত খেতে যাব, যাদের দামী এবং বাহারী আল্পনার ডিনার সেট কেনার সামর্থ নাই, তারাই খাবে মাটির বাসনে ভাত। সভ্য সমাজের সাথে বিষয়টা ঠিক যায় না, সভ্য সমাজে মাটির পাত্রে আহার পরিবেশন করা অতীব লজ্জাজনক একটি বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। ধরে নিনাল, আপনার পরিবার প্রতিবেলার আহারের জন্য মাটির পাত্র ব্যবহার করেন, হঠাৎ করে যদি আপনার বাসায় কোন আত্মীয় চলে আসে, আপনি কি পারবেন আপনার আত্মীয়কে মাটির পাত্রে খাবার পরিবেশন করতে। কখনোই পারবেন না, লজ্জায় আপনার মাথা কাঁটা যাবে।
উপরের কথাগুলো আমাদের সভ্য সামাজের পক্ষ থেকে আমি উপস্থাপন করলাম। যেহেতু আমি আধুনিক এবং সভ্য বাঙ্গালী সামাজের একজন মানুষ তাই আমি আমাদের আধুনিকতা এবং সভ্যতার সর্বচ্চো না হলেও অধিকাংশ বিষয়গুলোই জানি। তাই কথাগুলো বলতে আমার কোন প্রকার সংকোচ বোধ হলো না, বরংচ মনে মনে গর্ববোধ হচ্ছে, যেমন হয় পাশাপাশি বাসার দুই গৃহিনীর মধ্যে। “আপা জানেন, আমি কালকে বিকাল বেলা শপিং এ গিয়েছিলাম, শপিং থেকে ফেরার পথে সাইনপুকুরের একটা আউটলেট চোখে পড়ল। ভাবলাম একটু উকি দিয়ে দেখি নতুন বাহারী ডিজাইনের কোন ডিনার সেট পাওয়া যায় কিনা। আপা বিশ্বাস করবেন না, আমি ভিতরের ঢুকতেই একটা ডিনার সেট চোখে পড়ল, একটু দাড়ান আপনাকে দেখাই ডিজাইনটা। দেখছেন আপা, কি-সুন্দুর! আপা জিনিসটা যেমন সুন্দর এর দামটাও কিন্তু তেমন জানেন, যেহেতু জিনিসটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল,তাই কোন প্রকার দামা দামি করি নাই, সতের হাজার টাকা চাইলো, আমি সতের হাজার টাকা দিয়াই নিয়ে এসেছি, আপনার ভাইজান ও খুব পছন্দ করেছেন। আগামী মাসে আমাদের ম্যারেজ এ্যানিভারসারি, আপনার ভাইজান বলেছেন, সেই দিন আত্মীয়দের এই ডিনার সেটে খাবার পরিবেশন করতে। আমাদের দেশে কোন একটি সম্ভ্রান্ত এবং আধুনিক পরিবারের গৃহিনীদের জন্য এই বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক, তারা তাদের আধুনিকতাকে বৈচিত্রময় এবং রঙ্গীন করার গর্বে গর্বিত থাকেন সর্বদা।
আধুনিক হওয়া এবং আধুনিক সভ্যতার সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে নিজেদের মানুষিকতা এবং রুচির পরিবর্তন করা নিসন্দেহে খারাপ কোন বিষয় নয়। বিষয়টা খারাপ ঠিক তখনি হয়, যখন সভ্যতার বিকাশ এবং আধুনিকায়ন আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং চিন্তাধারার উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং এই প্রভাব বিস্তার যদি আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বিনাশের কারন হয়ে দাড়ায়, ঠিক তখনি বিষয়গুলো আমাদের দেশ ও জাতির জন্য সত্যিই ক্ষতির কারন হয়ে দাড়ায়। আমাদের দেশ এবং সমগ্র বাঙ্গলী জাতি নানাবিধ সমস্যায় জড়জড়িত, আমাদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বর্ননার্থে আমি যদি একটি দরিদ্র দিনমুজুর ব্যক্তির পরিবারের সর্বোপোরী সময়ের বাস্তবতার বাস্তব উদাহারন আলোকপাত করি, তাতেই আমাদের দেশের সার্বিক অবস্থা সকলের বোধগাম্য হয়ে যাবে।
আমাদের দেশে একটি বাস্তববাদী বাক্য খুবই প্রচলিত আছে, এবং কালের বিবর্তনে তা প্রবাদবাক্য রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। “আমি গরীব ভাই, আমার নুন আনতে পান্তা ফুরাই যায়”। এই একটি প্রবাদ বাক্যই আমাদের দেশের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারগুলোর সার্বিক অবস্থা ব্যাখা করার জন্য যথেষ্ট। তারপরেও আমি আরও কিছু যোগ করছি একটি কাল্পনিক গল্পের মাধ্যেমেঃ
”সকাল বেলা যখন, কামের খোঁজে বাড়ি থাইক্যা বাইর হইয়া যামু, বউ কইলো, ওগো ছখিনার বাপ, ঘড়ে নুন নাই, তরকারি পাকামু কেমন কইড়া, কাম থাকি আসার সময়, দোকান থ্যাইকা গরু খাওয়া নুন নিয়া অ্যাইসেন আধে সেড়। “আরও শোনেন কথা শেষ না হইতে দৈাড় পারেন ক্যা, ছখিনার দুই দিন থাইক্যা, আইতের বেলায় জ্বর আসে, প্যাইল্যে মাইয়াটার জন্য দুইটা জ্বরের ট্যাবলেট নিয়া অ্যাইসেন, আর তাড়াতাড়ি কাম থ্যাইকা অ্যাইসেন তো, পোলাপানগুলা আপনার আশায় থাইকতে থাইকতে না খায়া ঘুম্যাই যায়। সকাল বেলায় বউয়ের কথা শুনি মেজাজ গরম হইয়্যা গেল। তারপরেরও বউয়ের উপর রাগ দেখ্যাইতে পাররুল না, কারন হ্যা তো নিজের জন্য কিছু চাইলো না, যা চাবার তা মোর বাচ্চাগুলার জন্যই চাইলো। দিন শেষে যখন কাম করি মাত্র দেড়শ টাকা পালুম, পোনেরো ট্যাকা দিয়া আধে সেড় গরু খাওয়া নুন, এক সের চাউল, আঁধে সেড় আলু, আধে সেড় বেগুন কিইন্যা,খালি দুই ট্যাকা বাইচলো, দুই ট্যাকা দিয়ে একটা দোকান থ্যাইকা আটটা আজিজ বিড়ি কিইন্যা যখন বাড়ির কাছা কাছি চইল্যা আসলাম, তখন মনত পইড়লো মোর মাইয়্যাটার না গায়ত জ্বর, বউ দুইটিা ট্যাবলেট নিবার কইছিলো। কাছততো আর একটা ট্যাকাও নাই। যাই দ্যাখি ওষুধোর দোকানোত, দুইটা জ্বরের ট্যাবলেট বাকি নিয়া আসি। বাড়িত আসার পড় বউ সেই একসের চাউল মাটির হাড়ীত রান্না কইরলো। সাবাই খাইয়্যা ঘুমাইলাম। সকাল বেলা পন্তা খাইয়্যা কামে যামু, কিন্তু সকালে মুই যদি পন্তা খাইয়্যা কামত যাম মোর পোলা মাইয়্যারা কি খাইবো, হায়রে কপাল আইজকা বাসত নুন আছে কিন্তু পান্তা ফুরাই গেছে।
এই দরিদ্র দিনমজুরীর পরিবারের মতোই ঠিক আমাদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, আমাদের নুন আনতে প্রকৃত পক্ষেই পান্তা ফুরিয়ে যায়। গ্রামে, শহরে, বস্তিতে, আবাসিক এলাকা সর্বত্রই হাজারো বললে ভুল হবে, লক্ষ লক্ষ সমস্যা। দেশের অভ্যন্তরীন অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানেই আমাদের দেশের সরকার ব্যতিব্যস্ত। আর আমারা সাধারন যারা আমজনতা,তারতো নিজেদেরকে জীবন সংগ্রামের রনক্ষেত্রের অর্জুন বানিয়ে ফিলেছি। পরিবারের সমস্যা সামাধান করতেই আমরা হিম এবং শিমকে গুড় আর লবনের শরবত বানিয়ে খাচ্ছি। আমারা কিভাবে আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর রাখতে যাব বলুন। আর অন্য দিকে যে, সমাজের উচ্চ এবং ধনী শ্রেনীর ব্যক্তিরা দেশের ভিতরে আধুনিকতার পারমানবিক বোমা প্রতিনিয়ত বিষ্ফোরন করেই চলছে। আর সেই বিষ্ফোরনের সমাজের উঁচু, নিঁচু, ধনী, দরীদ্র কোন জাতিই রক্ষা পাচ্ছে না, এবং আধুনিকতার নামে আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সমূলে বিনাশের যে সর্বনাশা খেলা আমরা সমগ্র জাতি মিলে মিশে খেলছি, এর শেষ কোথায় আমরা কেউ কি বলতে পারি! যদি বলতে পারতাম এর উত্তোরনের উপায়টাও আমাদের ঠিক জানা থাকত।
আমি নিজেকে পরম সুভাগ্যবান মনে করি, কারন ছোট বেলায় আমাদের পাঠ্যপুস্তকে আমি বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুঁটিরশিল্প সম্পর্কে পড়েছিলাম। তাই কামার, কুমাড় এবং তাঁতি নামগুলো জানতে পেরেছিলাম এবং তারা কি করে সেটাও জানতে পেরেছিলাম। অন্যথায়, অতি আধুনিক সভ্যতায় বাস করে কেউ যদি, আমার কাছ থেকে জানতে চাইতো ভাই কামার শব্দের অর্থ কি? এই প্রশ্নের জবাব দিতে আমাকে গুগল করা ছাড়া কোন উপায় থাকতো না,কারন আমাদের বর্তমান আধুনিক জীবন যাপনের কোন ক্ষেত্রেই আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্ব কুঁটির শিল্পের কোন প্রকার অস্তিত্ব নেই।
বিশ্বব্যাপী বাংলার কুঁটির শিল্পের যে সুনাম এবং সার্বজনিনতা, তার অধিকাংশটাই মৃৎশৃল্পের দখলে ছিল। ইতিহাসে সমগ্র বাংলা ব্যাপী এই মৃৎশিল্পের কারিগর কুমাড় সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব খুবই উল্লেখযোগ্য। বাংলার এমন কোন গ্রাম খুঁজে পাওয়া বড়ই দুষ্কর ছিল, যে গ্রামে কুমাড় পাড়া ছিল না। ইতিহাসে কুমাড়রা আমাদের বাংলার সমাজের হয়তোবা উঁচু শ্রেনীর কোন জাতি গোষ্ঠি ছিলেন না, কিন্তু তারা তৎকালিন সময়ে আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্দ একটি অংশ ছিলেন। যারা আমাদের সমাজের এক সময় অবিচ্ছেদ্দ অংশ ছিল, তারা কিভাবে আমাদের সামাজ থেকে বিলিন হয়ে গেলেন, আর আমাদের সমাজের গায়ের চামড়া এতোই মোটা যে আমাদের সমাজের শরীরের এতো গুরুত্বপূর্ন একটা অঙ্গ নষ্ট হয়ে নিশ্চিন্ন হয়ে গেল, আর আমাদের সমাজ কিছুই বুঝতে পারল না! কুমাড়রা তাদের অতুলনীয় সৃষ্টিজ্ঞানে মৃৎশিল্পের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য গার্হস্থ্য দ্রবাদি,মাটির হাড়ী, মাটির কলস, মাটির বাসন (খাবার পাত্র), মাটির গ্লাস, সরা, তাছাড়াও মাটির তৈরী পয়সা রাখার পাত্র (যাকে আমরা মাটির ব্যাংক বলি), ফুলদানি, মাটির পুতুল, টালী, দেবদেবীর মূর্তি, ভাস্কর্য, মশনঘাট ইত্যাদি তৈরী করতেন। প্রতিটি সৃষ্টিতেই ছিল অপূর্ব কারুকাজের নিপুন ছোয়া,চোঁখ ধাঁধানো অল্পনা, তাইতো কুমাড়দের সৃজনশীল সৃষ্টি বিশ্বসভ্যতার কাছ থেকে শিল্পের সম্মাননা পেয়েছেন।
বেক্সিমকো কোম্পানির সাইনপুকুর সিরামিক দিয়ে বৈদেশিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যতোই বাহারী ডিজাইনের ডিনার সেট তৈরী করুক না কেন তা কখনোই শিল্প রুপে বিশ্ববাসির কাসে সমাদৃত হবে না। শরীফ মেলামাইন মেলামাইনের প্লেট, বাটি, গ্লাস, টি স্ট্রে, চামচ এর যতই বাহারী আল্পনা একে পিছনে সিংহ মার্কা লাগিয়ে তাদের তৈরীকৃত সঠিক মানের পন্য হিসাবে বিজ্ঞাপন প্রচার করুন না কেন, শরীফ মেলামাইনের এই সৃষ্টিকে বিশ্ববাসি কখনোই শিল্প হিসাবে সামাদৃত করবে না। তাহলে বাঙ্গালী সমাদৃত হবে কোথায়, সেটা আমার জানা নেই, তবে বাংলার ইতিহাস সাক্ষী বাঙ্গালী যুগের পর যুগ সমাদৃত হয়েছিল তাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের জন্য।
মাটির তৈরী একটি ফুলদানি বর্তমানে হয়তোবা ধনী ব্যক্তিদের বাড়ির বারান্দায় অথবা মাটির তৈরী ফুলের টব বাড়ীর ছাদে শোভা পায় এর অর্থ উক্ত ধনী বা সভ্য ব্যক্তিরা আমাদের মৃৎশিল্পের ব্যবহার এখন অবধি করছেন। পরুন্ত ভালো করে খবর নিয়ে দেখেন ওই ধনী ব্যক্তি যে ফুলের গাছের জন্য ফুলদানিটি কিনেছেন, সেই ফুলগাছটা অনেক দামী। তিনি ফুল গাছটার জন্য মাটির তৈরী ফুলের টব কিনেছেন, টব কিনে টবের জন্য ফুলগাছ কেনেন নাই। আর আমরা আমাদের অতি অমূল্য এই মৃৎশিল্পকে হারিয়ে ফেলেছি শুধু মাত্র আমাদের সুস্থ্যচিন্তাহীন জীবন ব্যবস্থার জন্য। মাটির তৈরী যে সব দ্রব্যাদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা হয়, তা কোন অংশেই, সিরামিকের তৈরী, মেলামাইনের তৈরী কিংবা গ্লাসের তৈরী দ্রব্যাদির তুলনায়, গুনগত, স্থায়িত্ব, মানানশৈলীতার দিক থেকে কম নয়। বরংচ কয়েকধাপ এগিয়ে, স্বাস্থ্যগত দিক থেকে। মাটির হাড়ী কিংবা পাতিলে রান্না করা খাবার, গ্যালভানাইজড স্টিল এ তৈরী হাড়ী কিংবা পাতিলে রান্না করা খাবারের তুলনায় বহুগুনে স্বাস্থ্যসম্মত, কোন প্রকার খারাপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, যেটা আছে গ্যালভানাইজড স্টিল এ তৈরী হাড়ী কিংবা পাতিলে রান্না করা খাবারের মাঝে।
আমাদের জীবনতো রাজা বাদশাদের জীবনের চেয়ে বিলাসবহুল নয়, রাজা বাদশারা যেখানে মাটির তৈরী দ্রব্যাদি ব্যবহার করাকে তাদের সম্মানহানীজনক বলে মনে করতেন না তাহলে আমারা কেন তা মনে করি। কুমাড়দের শিল্প ক্ষচিত দ্রব্যাদি ব্যবহার বিলাসিতা সমরূপ কারন অপরূপ কারুকার্য কখনোই তাচ্ছিলতার স্বীকার হতে পারে না। যে ব্যক্তি বা যে জাতি শিল্পের কদর জানে না, শিল্পের প্রকৃত অর্থ জানে না সেই ব্যক্তি বা জাতি মৃৎশিল্পের তৈরী দ্রব্যদী ব্যবহার করতে সংকোচবোধ করবেন। কথটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই চরম বাস্তবতা আজ আমরা বাঙ্গালীরা প্রকৃত শিল্পের কদর করতেই ভূলে গেছি। আধুনিকতা আমাদের সীমাবদ্ধতা না আধুনিকতা আমাদের অজুহাত হয়ে দাড়িয়েছে। পশ্চাৎ ধারায়, পশ্চাৎ শিল্পের প্রসারন না ঘটিয়ে, আধুনিকতার জন্য আমাদের দেশ ও জাতির ঐতিহ্যকে আধুনিক করে তোলার কোন প্রকার চেষ্টা এখন অবধি আমরা করি নাই। বাঙ্গালী যে অনুকরনপ্রেয়সী তার যথাপুযুক্ত প্রমাণ আমারা রেখেই চলছি, আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য,সংস্কৃতি, মর্যাদার নির্মম জলানজ্বলি দিয়ে।
আমরা এবং আমাদের সরকার চাইলেই হাজার কোটি টাকা অর্থায়নে সিরামিক, মেলামাইন এবং গ্লাসের তৈরী দ্রবাদির কারখানা তৈরী না করে, সেই অর্থায়নের এক তৃতীয়াংশ অর্থব্যয়ে আমাদের কুমাড় নামের ক্ষুদ্র মৃৎশিল্পীদের পৃষ্ঠপোশকতা করে, মৃৎশিল্পকে সভ্যতার স্পর্শে আধুনিকায়ন করে এর প্রসার শুধু দেশের অভ্যন্তরেই না বৈদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হতাম, কারন মৃৎশিল্প একটা অসাধারন শিল্প, আর শিল্পের কদর মানুষের হৃদয়ের গভীরের, প্রযুক্তির কদর আমাদের বাহ্যিক চাকচিক্যে।
উত্তরার আজমপুরের তিন রাস্তার মোড়ে বয়স্ক একজন মৃৎশিল্পীকে আমি দেখতে পাবো এটা কখনোই আশা করি নাই। ঢেলাগাড়ীর মতো একটা ভ্যানগাড়ীতে করে লোকটা মৃৎশিল্প তথা পোঁড়া মাটির তৈরী কিছু দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে প্রচন্ড রোদের ভিতরে দাড়িয়ে ছিলেন। তার কাছে আমি কিছু পরিমান পোঁড়া মাটির ব্যাংক, কিছু পরিমান সরা (মাটির তৈরী ঢাকনা), কয়েটা মাটির তৈরী গামলা (বোল), কয়েকটি ছোট, বড় এবং মাঝারী আকারের মাটির তৈরী ফুলদানি এবং কিছু মাটির তৈরী এ্যাশট্রে দেখতে পেয়েছিলাম। তার গাড়ি ভর্তি পোঁড়া মাটির দ্রবাদি ছিল, তার পরেও এই সব দ্রবাদি দেখে তাকে আমার খুব অসহায় লেগেছে, কেন বলতে পারেন? তার সেই ছোট ঢেলাগাড়ীতে ছিল না কোন প্রকার মাটির হাড়ী, মাটির তৈরী পাতিল, মাটির তৈরী থালা, মাটির তৈরী কলস। তার এই অসহায়ত্বের পিছনের আপনি, আমি এবং আমারা সমগ্র বাঙ্গালী জাতি দায়ি। কারন আমারা বর্তমানে আর আমাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থায় পোঁড়ামাটির কোন দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহার করি না।
যদি কখনো আমাদের বিলাসী মনে সামান্যতম বাঙ্গালীপনা উঁকি মারে, তাহলে হয়তো আমারা শখ করে একটা ফুলদানি, আমার সদ্য বেড়ে ওঠা শিশুটাকে সঞ্চয়ী করার লক্ষ্যে একটা পোঁড়ামাটির ব্যাংক এবং যদি ধুমপানের বদনেশা থাকে তাহলে সিগারেটের অ্যাশ ফেলার জন্য মাটির তৈরী অপরূপ এ্যাশট্রে কিনতে পারি,তারপরেও প্রশ্ন আছে সেটা কিনার জন্য বিশ টাকা বা ত্রিশ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে কোথাও যেতে রাজি না আমরা, যদি সেটা হাতের নাগলে পাওয়া যায় তবে কেনার চেষ্টা করে দেখতে পারি আমরা। বয়স্ক লোকটি এক বুক হাতাশা নিয়ে সিগারেট টানছিলেন, তিনি তার মাটির তৈরী এ্যাশট্রের প্রচার করার বিন্দু মাত্র চেষ্টা করছিলেন না, তিনি সভ্য সমাজের মানুষগুলোর সামনে দীর্ঘ নিশ্বাস নিতে লজ্জাবোধ করছিলেন, তাই হাতাশার দীর্ঘ নিশ্বাসগুলো সিগারেটের ধোয়ার সাথে নিজের বুকের ভীতের প্রবেশ করাচ্ছিলেন এবং বিষয়টা তার মূখমন্ডলে আমি স্পষ্টভাবে দেখতে পারছিলাম। শিল্পীর শিল্প হারিয়ে যায় নাই, শিল্পীর শিল্প আজ অনাহারে আকুতি করছে, আমি ঠিক গরীব বলব না দরিদ্র কোন কুমাড়ের ছোট্ট কুঠিরে, ক্ষুদার সেই তীব্র যাতনা শিল্প তার শিল্পীকে যাতানা দিচ্ছে, শিল্প আজ মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাড়িয়ে, শিল্পী আজও অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে তার শিল্পকে বাঁচানোর জন্য। যে মাটি দিয়ে আমাদের এই নশ্বর দেহখানী তৈরী, সেই মাটি পুঁড়িয়ে শিল্প শিল্পকে রূপদান করে থাকেন তাই হয়তোবা, ”পোঁড়ামাটির অভিশাপে শিল্পীর আজ পোঁড়া কপাল”।
Thanks for being with me.
I'm @shadonchandra a proud Member of @bdcommunity.
Find Me on Twitter, Because I used To Share Beautiful Photography every day on My Twitter Account.
Find Me On Facebook, Because I used To Share Some Beautiful Thought Of Life in my Facebook Profile.
Have a very nice Day...