প্রাচীনকাল থেকে কবিদের দুইটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়.. একটি ধারা সবসময় তাদের সাহিত্য মেধার বিনিময়ে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে চেষ্টায় থাকে.. এটা অবশ্য মন্দ নয়.. পেশা হিসেবে কাব্য চর্চা কিংবা সাহিত্যচর্চা সিরিয়াসলি নেওয়া সাহিত্যের জন্য ভালো.. তবে তার চেয়ে আরো বেশি ভালো দ্বিতীয় আরেকটি ধারা.. যেখানে দেখা যায় কবিগন কোন পার্থিব প্রত্যাশা মনে স্থান না দিয়ে শুধুমাত্র মনের আনন্দে সাহিত্য রচনা করে।
আপনারা হয়তো কবি আল মাহমুদের সোনালী কাবিন-এর কথা শুনেছেন.. বাংলা সাহিত্যে এরকম কিংবদন্তিতুল্য কবিতা খুব কমই আছে। আল মাহমুদ কবি হিসেবে অনেকগুলো অবদান বাংলা সাহিত্যে রেখেছেন.. তবে তার সোনালী কাবিন অন্য সবগুলো অবদানকে এতটাই ছাপিয়ে গিয়েছে যে- কবি আল মাহমুদের প্রসঙ্গ আসলে প্রথমেই সবার মনে সোনালী কাবিন শব্দটি ভেসে ওঠে।
এই অসাধারণ কাব্যটির একটা জায়গায় কবি প্রথমে উল্লিখিত প্রসঙ্গটি এনেছেন.. কবিদের প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশা প্রসঙ্গ... এবং উদাহরণ হিসেবে দুইজন অসাধারণ কবি ষকে সামনে এনেছেন- আলাওল এবং লালন।
পূর্বপুরুষেরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়ার
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে উঠে বঙ্গের বাতাস
মুখ ঢাকে আলাওল- রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।
(সোনালী কাবিন: আল মাহমুদ)
যেহেতু আল মাহমুদ নিজেও কবিদের স্বগোত্রীয়.. তাই তিনি তার পূর্বেকার কবিদেরকে পূর্বপুরুষ বলে সম্বোধন করেছেন.. কবির ভাষায়- তাঁর পূর্বপুরুষরা বেশিরভাগই ছিল কোন না কোন সম্রাটের দাস.. অর্থাৎ রাজকবি.. বাংলা সাহিত্যে শুধু নয়, বিশ্ব সাহিত্যে অনেক বড় বড় কবি ছিলেন- যারা রাজকবি হিসেবে রাজদরবারকে অলংকৃত করতেন.. এটা সাহিত্যের ইতিহাসে একটা প্রতিষ্ঠিত বিষয়।
কিন্তু এর একটা কালো দিক আছে.. তাদেরকে অনেকটা বাধ্য হয়ে, কিংবা স্বার্থের তাগিদে রাজাদের স্তুতিমূলক কাব্য রচনা করতে হতো.. সাহিত্যের জন্য এটা খুবই লজ্জাস্কর.. নিজস্ব সাহিত্য-সত্তাকে আরেকজনের তোষামোদের জন্য ব্যবহার করতে হয়েছে।
যদিও রাজতন্ত্র বাংলাদেশ সহ অনেক দেশ থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে বহু আগেই.. তারপরেও সেই রাজকবি সুলভ তোষামোদ স্বভাব বিলুপ্ত হয় নি এখনও.. এই সময়ে এসেও অনেক কবিকে দেখা যায় স্বার্থন্বেষীভাবে তোষামোদিমূলক স্তুতিকাব্য রচনা করতে.. বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠীকে খুশি করার নিমিত্তে।
এখনকার সময়ে এটা এত বেশি বেড়ে গিয়েছে যে- রাজকবি আলাওল পর্যন্ত লজ্জা পাচ্ছে তাদের তোষামোদি দেখে.. সেজন্য কবি বলেছেন- মুখ ঢাকে আলাওল- রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।
পরের পংক্তিতে তিনি লালনের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন.. যুগে যুগে যেমন আলাওল ছিল, তেমনি ছিল লালনের মত স্বভাব-শিল্পীরা... যারা কবিতা রচনা করতেন, সংগীত রচনা করতেন মনের আনন্দে.. তারা কোন প্রতিদান প্রত্যাশী ছিলেন না.. কবি তাদের সেই মনের আনন্দে সাহিত্য সৃষ্টি করতেন। তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে কবি বলেছেন:
এর চেয়ে ভালো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল
আরশীনগরে খোঁজা বাস করে পড়শী মে জন
আমার মাথায় আজ চূড়ো করে বেঁধে দাও চুল
তুমি হও একতারা, আমি এক তরুণ লালন।
অর্থাৎ কবি নিজেও লালন ধারায় কাব্য রচনা করতে চাচ্ছেন। বর্তমান সময়ে এরকম অনেক কবিকেই খুঁজে পাওয়া যায়.. যারা লালনের মত সাহিত্যকে নিজেদের অন্তরে-মননে ধারণ করেন.. এবং নিজস্ব অভিরুচিকে প্রাধান্য দিয়েই সাহিত্য রচনা করেন.. কাউকে খুশি করার জন্য নয়.. তারাই প্রকৃত সাহিত্যিক।
উল্লেখ্য যে..
যদিও কবি আল মাহমুদ এই দুইটি ধারাকে প্রচন্ড জোরালো ভাবে আঘাত করে সাহিত্যের রস মিশ্রিত পংক্তিতে পরিবেশন করেছেন তার সোনালী কাবিন কাব্যে... মজার বিষয় হল- আল মাহমুদের জীবন বিচার করতে গেলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজেও শাসকগোষ্ঠীর মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করেছেন.. এবং তাদের থেকে বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করেছেন.. যেমন জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি শাসকের প্রিয়ভাজন ছিলেন.. এরশাদের আমলে তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।
আসলে অনেক সময় দেখা যায়- কবিতার সাথে কবির মিল থাকে না.. এটা সম্ভবত সাহিত্যের একটা বড় ধরনের ট্রাজেডি।
আমার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
আমি কাব্য, কর্মের সন্ধানে নিয়োজিত এক স্বপ্নবাজ তরুণ। মূলত কবিতা লিখতে ভালোবাসি। দীর্ঘদিন ধরে কাব্যচর্চা করছি। পাশাপাশি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও বিচরণ করি। পড়তে ভালো লাগে। সম্প্রতি ছবি আঁকা শিখছি।