নদীমাতৃক বাংলাদেশ। এখানে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল। নদী নিয়ে এ দেশের মানুষের আবেগ অনেক বেশি। তাই বাংলা সাহিত্যে নদী নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস এবং গল্প..
মধুসূদন কাব্যে নদী
বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মধুসূদন দত্ত লিখেছেন কপোতাক্ষ নদ। যেটা আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের সবাই পড়ে বড় হয়েছি। যেখানে কবি সুদূর বিদেশে গিয়ে মিস করেন তার শৈশবের কপোতাক্ষ নদীকে। আর তাকে নিয়ে রচনা করেন অনবদ্য সব পংক্তিমালা।
জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি
সবচেয়ে প্রভাবশালী আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে কবিতা। তিনি যখন বলেন: 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়'। তখন আমরা যেন চোখের সামনে দেখতে পাই একটা শান্ত শীতল নদী, তার শীতল বাতাস আমাদের মন প্রাণ জুড়ায়। আমাদেরও ইচ্ছা জাগে নদী হয়ে আবার এই বাংলায় ফিরে আসতে, কবির মতো।
এরকম আরো অসংখ্য কবিতা ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে লিখেছেন তিনি। বলেছেন: 'হায় চিল, সোনালী ডানার চিল। তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে।'
আল মাহমুদের তিতাস নদীর যৌবন
আরেক আধুনিক কবি আল মাহমুদও নদী নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। এমনকি নদী নিয়ে তিনি নামকরণ করেছেন তার কবিতার বইয়ের- 'নদীর ভেতরে নদী'। কবি তার শৈশবের তিতাস নদী নিয়ে লিখেছেন কবিতা।
কবি আল মাহমুদের একটি বিশেষ দিক ছিল- তিনি নদীর মাঝে তার প্রিয়সিকে খুঁজে পেতেন। কবি বলেছেন, 'তোমাকে খুঁজতে গিয়ে প্রতিবারই পেয়েছি নদীকে/ প্রতিবারই স্রোত ছুঁই, ছুঁতে গিয়ে শাড়ির আঁচল/ তোমার আবার খুঁজে একদা হাটি নি কি দিগন্তের দিকে?/ এখন অসীম শূন্যে তারা জ্বলে, পদ তলে অনিঃশেষ জল।'
বিখ্যাত 'সোনালী কাবিন' কবিতায় তিনি লিখেছেন- 'গাঙের ঢেউয়ের মতো তীব্র দুটি জলের উচ্ছ্বাস/ তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়/ চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাজ/ উগল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়।'
রবি ঠাকুরের ছোট নদী
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি কবি রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলও তাদের কবিতায় বারবার নদী প্রসঙ্গ এনেছেন। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কিশোর কবিতা 'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে'- আমরা সবাই ছোটবেলায় পড়েছি। মনে হয়, এমন কোন বড় কবি এদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না- যিনি নদী নিয়ে বেশ কিছু কবিতা লেখেন নি। নদী নিয়ে মুগ্ধতা ছিল না এমন কেউ নেই।
গল্পে নদীর প্রভাব
গল্প উপন্যাসে নদী ও নদীর তীরবর্তী মানুষদের জীবনধারা নিয়ে অনেক প্রসঙ্গ আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে জোক কিংবা জলবেশ্যা অনেক বিখ্যাত গল্প।
তসলিমার ফেরা এবং আমাদের লজ্জা
তসলিমা নাসরিনের বিখ্যাত উপন্যাস ' ফেরা '। সেখানে তিনি দেখিয়াছেন, একজন বিদেশ ফেরত নারীকে। যে দীর্ঘদিন পর তার শৈশবের ভূমিতে ফিরে এসেছে। তার খুব ইচ্ছে- শৈশবে যে নদীতে সে গোসল করতো, সাঁতার কাটতো, জলকেলি করত... সেই নদী তার বাচ্চাদেরকে দেখাতে। তার বাচ্চারাও কল্পনায় সেই ফুলে-ফেঁপে ওঠা যুবতী নদীকে ভাবতো। আর তাকে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো।
কিন্তু যখন সে তার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে আসে, আর দেখে নদীর আজকের অবস্থা, তখন সে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায়। আর বাচ্চারা বারবার জানতে চায়- মা, তোমার সেই নদীটা কোথায়? সে কোন জবাব দিতে পারে না।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- এই লজ্জাটা, আমরা যারা বাংলাদেশে রয়েছি এবং আমাদের চোখের সামনে নদী গুলো মারা যাচ্ছে, তাদের হয় না। বিব্রত হই না, লজ্জা পাই না, কষ্টও পাই না- নদীর মৃত্যু দেখে! আমাদের চোখের সামনে নদী গুলো একটু একটু করে যাচ্ছে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর, কয়েক দশক পর বাংলাদেশে হয়তো কোন নদী খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের কোন কবি হয়তো তখন নদী নিয়ে কোন কবিতা বা সাহিত্য রচনা করবে না আর। তাই আজ নদীর এই দুর্দশা নিয়ে লিখতে বসেছি।
নদী ধ্বংসের কারণ গুলো
• বাংলাদেশের নদী ধ্বংসের কয়েকটি প্রধান প্রধান কারনের অন্যতম হল- চর দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ওদের উপরে অবৈধ উচ্ছেদ নদীর গতি প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে দেয় এবং তার স্বাভাবিক স্রোতকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে নদী তার স্বাভাবিক রূপ হারিয়ে ক্ষীণধারায় ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে এবং একসময় শেষ হয়ে যায়।
• আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো- তার নাব্যতা। নদীর উপর পলিমাটির আস্তর পড়তে পড়তে একসময় তার নাব্যতা অর্থাৎ জল ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। এর জন্য যে নিয়মিত ড্রেসিং করা দরকার, সেটি কর্তৃপক্ষের না করায় নদী গুলো মারা যাচ্ছে।
• আরেকটা কারণ হলো, অপরিকল্পিত বাঁধ। নদীতে অপরিকল্পিত ভাবে বাঁধ দেয়া এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বৈরী আচরণের ফলে নদী চরিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে নদী তার স্বাভাবিক চরিত্র হারিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। যখন নদীতে পানি থাকার কথা, তখন পানি থাকছে না। আর যখন পানি থাকার কথা না, তখন প্লাবিত হচ্ছে নদীর দুই পাশ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তীরবর্তী ফসলি জমি, গবাদি পশু এবং মানুষের আবাস।
• এছাড়া আরো অনেক কারণ আছে, যেমন- পরিবেশ দূষণ, অতিরিক্ত আবর্জনা, পানি দূষণ ইত্যাদি।
সমাপিকা ক্রিয়া
আমাদের উচিত এখনই নদীর এই সংকট কাটিয়ে তাদেরকে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হওয়া। নইলে একদিন নদীহীন বাংলাদেশ আমাদেরকে দেখতে হবে।
The post is created by:
Hi, I am Tariqul Islam.
I like Writing & Photography.
If you like literature, blogging & art; you may be connected with me:
Hive: tariqul.bibm
Facebook: Tariq Bin Mutalib
_Stay Connected_