এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জনপ্রিয় নেতা শমসের সাহেব মারা গেছেন। সকাল থেকে তার বাসার সামনে প্রচন্ড ভিড়। গিজগিজ করছে মানুষ। অবশ্য কারো কারো চোখে মুখে শোকের কোন চিহ্ন নেই। সবাই যেন ফটোসেশনে ব্যস্ত। বিশেষ করে শমসের সাহেবকে শেষ দেখা দেখতে বড় বড় নেতা-নেতৃবৃন্দ যখন আসছেন, তখন সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে নেতার সাথে ছবি তোলার জন্য। নেতাদের সাথে কিছু ছবি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে নিজের স্ট্যাটাস একটু বাড়ে।
শমসের সাহেব দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করতেন এলাকায়। একজন ভাল নেতা হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। এদেশের প্রেক্ষাপটে যদিও ভালো রাজনীতিবিদ শব্দটা আপেক্ষিক। একজনের কাছে ভালো নেতা মানে অন্যজনের কাছে খারাপ। কারণ এখানে মানুষ রাজনীতি করে নিজের জন্য, কথা বলে দলের জন্য। বিপক্ষ দলের নেতা যত ভালই হোক না কেন, তাকে প্রশংসা করা যাবে না- এটা এদেশের রাজনীতির নিউটনের তৃতীয় সূত্র।
তবে মারা গেলে শোক বার্তা পাঠানো, জানাযায় যাওয়া এবং সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়া নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র। সেই সূত্র অনুসারে এলাকায় তার যত প্রতিদ্বন্দী এবং পক্ষ-বিপক্ষ দলের, অন্যান্য গ্রুপের নেতা-নেতৃবৃন্দ আছেন, সবাই এসেছে। সবার হাতে ফুলের মালা ও বুকেট। এত ফুল বহন করে মৃত শমসের সাহেব কবর পর্যন্ত যেতে কষ্ট হয়ে যাবে।
একটু পরে জানাযা শুরু হবে এলাকার ইস্কুল মাঠে। অত্র এলাকায় এটাই সবচেয়ে বড় উদ্যান। সেটাও কানায়-কানায় ভর্তি হয়ে আশপাশের রাস্তা ঘাটেও মানুষের ঢল নেমেছে। অনেক টানাহেঁচড়া করে শমসের সাহেবের লাশ মাঠের মধ্যে আনা হল। মানুষের ভিড় ঠেলে আনতে গিয়ে কয়েক বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পড়ে গেলে কি কেলেঙ্কারিটাই না হতো!
জানাযায় লাশ আসার পরে শুরু হল আরেকটা গোপন নিরব রাজনীতি- কথা বলার রাজনীতি। ব্রিটিশরা এদেশে করে গেছে শাসন, পাকিস্তানিরা করে গেছে শোষণ, এখন আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা করে ভাষণ, আর আমরা করি তাদের তোষণ, এই হলো আমাদের রাজনৈতিক দর্শন।
রাজনীতিবিদরা ভাবে তাদের কথা আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছি- আর অন্য পক্ষে আমরা ভাবি আমাদের তোষণে রাজনীতিবিদরা গলে গলে পড়ছে।
মাইকের রাজনীতিতে একটা পর্যায়ে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম হল। কে কে কথা বলবে, কে কথা বলবে না- এগুলো নিয়ে তুমুল গুটিবাজি। এদিকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারন মানুষ বিরক্ত। পিছন থেকে বারবার আওয়াজ আসছে- জানাযা শুরু করেন, জানাযা শুরু করেন। কে শুনে কার কথা? কথা বলতেই হবে! কথা না বললে নেতার যে মন থাকে না।
শমসের সাহেবের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তারই দলের মৌসুমি নেতা বোতল বদরুল। বদরুল মিয়া যতটা না নিজের নামে পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত বোতল বদরুল নামে। জানা যায়- একসময় সে নাকি বোতল সাপ্লাই দিত। এলাকায় যার বোতল দরকার হতো- দেশি কিংবা বিদেশি, তার কাছে পাওয়া যেত। সেই ব্যবসা থেকে আজ সে বিশাল ব্যবসায়ী। ব্যবসা করে টাকা পয়সা জমানোর পর শখ হয়েছে রাজনীতি করার- একটু ক্ষমতার স্বাদ চেখে দেখার। তাই সে টাকা ঢেলে এলাকায় নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছে। টাকা কথা বলে। এখনকার রাজনীতিতে টাকাই একমাত্র সামর্থ্য এবং একমাত্র যোগ্যতা।
সমাপনী বক্তৃতা দিতে দেওয়া হল বোতল বদরুলকে। কারণ সে এলাকার বর্তমান চেয়ারম্যান। সে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সমশের সাহেবের কথা প্রসঙ্গে আবেগে চোখের পানি বের করে ফেললেন। উপস্থিতি মানুষজন তার কান্না দেখে চোখ মুছতে শুরু করলো। সে এক আবেগঘন দৃশ্য।
জানাজা শেষ করে বদরুল মিয়া সমশের সাহেবের একমাত্র ছেলে রাফিকে বলল: আজকে থেকে বাবা আমিই তোমার গার্জিয়ান। তোমার যখন যা লাগে আমাকে বলবা। তাকে জড়িয়ে ধরতেই ছেলেটা হুহু করে কেঁদে ফেলল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন।
জানাজা শেষ করে বদরুল মিয়া ওরফে বোতল বদরুল ঘরে এসে ক্লান্তিতে সোফায় নেতিয়ে পড়ল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল: যাক, আপদ বিদায় হয়েছে। তার পিএস পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে জিজ্ঞাসা করলো: স্যার একটু আগে না আপনি কান্দেন দেখলাম, এখন আবার কইতাছেন..
তার পিএসটা একটু বোকাসোকা টাইপের, রাজনীতি বোঝে না। অবশ্য বোকা বলেই তাকে বদরুল মিয়া পিএস হিসেবে রেখেছেন। রাজনীতিবিদদের ম্যানেজার, পিএসএ ইত্যাদি একটু বোকাসোকা মানুষ প্রয়োজন হয়। না হলে তারাই একটা সময় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
বদরুল মিয়া বললো: আরে বুঝলি না? আমার এলাকায় একমাত্র পথের কাঁটা ছিল সমশের। আমার সামনে দাঁড়ানোর মত আর কেউ নেই। এমপি সাহেব সামনে আর ইউ নির্বাচন করবেন না। শমসের যেহেতু নাই, এখন সামনের এমপি ইলেকশনে আমিই প্রার্থী হব।
-কিন্তু স্যার, শমসের সাহেবের যেই পরিমাণ জনপ্রিয়তা- মাইনষে যদি তার ছেলেরে নির্বাচনে চায়?
বদরুল তার পিএস-এর দিকে তাকাল: তোরে যতটা বোকা মনে করছি, তুই তো দেখি এতটা বোকা না! ভালো একটা কথা মনে করছস। এখনই ওসি সাহেবকে ফোন দিয়ে বল- দুই তিনটা মামলা রেডি করতে।
-কার জন্য মামলা?
-আরে গাধা এতক্ষণ কি বলতেছি। শমসের সাহেবের ছেলে, তারে মামলায় আটকাইতে পারলে আমার রাস্তা ক্লিয়ার।
_-কন কি স্যার! একটু আগেই না আপনি কইলেন- আপনি তার গার্জেন?
-ওইটা ছিল রাজনীতির কথা। এত বছর পিএস-গিরি করিস, এখনও তুই রাজনীতির ভাষা বুঝস না?
পিএস অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রাজনীতি জিনিসটা সে এখনো পুরোপুরি বুঝে না। সকালে এক, বিকালে আরেক।
আত্মকথনঃ
আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।
- Hive: My Blog
- LeoFinance: My Leo
- Dtube: My Tube
- 3speak: My Vlog
- Twitter: My Tweet
- FB: My Profile
- Pinmapple: My Tour
- TravelFeed: My Feed
"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"
জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি