কবিতা সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা। এমনকি যখন গল্প-উপন্যাস রচিত হয় নি... তখন কবিতা রচিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ছন্দের প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত দুর্বলতা।
মানুষ স্বভাবতই ছন্দ ভালোবাসে। ছন্দে কথা শুনতে পছন্দ করে.. ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতেও ভালো লাগে। আপনারা দেখবেন- রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেয়াল লিখন যদি চোখে পড়ে.. সেগুলো ছন্দ মেলানোর চেষ্টা থাকে.. অমুক ভাইয়ের চরিত্র/ফুলের মত পবিত্র। অথবা কোনো ক্যানভাসার যখন ক্যানভাস করে.. কিংবা সরকারি বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা ব্যবহার করা হয়.. সাবান দিয়ে হাত ধোন/ করোনা থেকে নিরাপদ হোন।
এটা শুধু আজকের দিনে না.. একেবারে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। যখন থেকে মানুষ কথা বলতে শিখেছে.. তখন থেকেই মানুষ শব্দের এই মেলবন্ধন দেখে বিস্মিত হয়েছে, তখন থেকেই কবিতার সৃষ্টি। এই হিসেবে আমরা বলতে পারি- যখন থেকে ভাষার সৃষ্টি.. তখন থেকেই মানুষ কবিতাকে লালন করে ধারণ করে।
যুগে যুগে কালে কালে কবিতা অনেক পালাবদল হয়েছে। প্রথমে ছন্দ থেকে শুরু হয়.. এরপর কবিতা গিয়েছে ঘটনার মধ্যে। কবিতার ভেতর ঢুকে গেছে মানুষের জীবনের ঘটনা। এর মধ্যে যুদ্ধ একটা বড় ভূমিকা পালন করত। কারন একটা সময় যুদ্ধই ছিল বীরত্বের অন্যতম প্রতীক। তাই কবিতাগুলো রচিত হত যুদ্ধে নায়কের খলনায়কের পরাজয়ের বীরত্বগাথা নিয়ে।
এরপর আসে ট্রাজেডি। আর যখনই ট্রাজেডি আসে.. তখন নায়কও কখনো কখনো পরাজয় বরণ করতে শুরু করে। এরপর কবিরা অন্যান্য ট্রাজেডির দিকে মনোযোগ দেন। শুধুমাত্র যুদ্ধের গল্প বলতে বলতে কবি ক্লান্ত.. শ্রোতারাও শুনতে শুনতে ক্লান্ত। তখন কবিরা জীবনে অন্যান্য যে সকল বেদনা অনুভূতি রয়েছে.. সেগুলোকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। সেই থেকে আসলো মানবীয় অনুভূতির যেমন প্রেম-ভালোবাসা এবং অন্যান্য মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েন।
কবিতার ডাইমেনশন চেঞ্জ হতে লাগল.. এবং এর বহুমাত্রিকতা আসলো। এর ফাঁকে ঢুকে গেল কমেডি। তখন মানুষ বুঝতে পারল যে- কবিতা সাহিত্য শুধুমাত্র বেদনা নিয়ে নয়.. হাস্যরসও এর একটি অন্যতম খোরাক। যেহেতু কমেডি আমাদের চিত্তপ্রফুল্ল করে এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের বেদনা, হতাশা ও অন্যান্য নেগেটিভ অনুভূতিগুলোকে দূরে সরিয়ে দেয়.. তাই কমেডি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে শুরু করল।
প্রথমে কবিতাগুলো শুধু পাঠ করা হতো। অনেকটা আমাদের দেশের পুঁথিপাঠের মতো। পুঁথিপাঠ নিয়ে আমি বিস্তারিত আগের একটি পোস্টে বলেছি। আপনারা চাইলে পড়ে দেখতে পারেন: পুঁথি সাহিত্য, সবুজ স্বপ্নের দেশে..
তারপর আসলো কবিতার বয়ান। কিছু কিছু কবি চিন্তা করল.. শুধুমাত্র কবিতা বলে গেলে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে ধরে রাখা অনেক কঠিন হয়ে যায় অনেক সময়। তাই তারা একটু অঙ্গভঙ্গি করে কবিতা বলতে শুরু করল। সেই থেকে অভিনয়ের সৃষ্টি। এ থেকে আমরা বলতে পারি- কবিতা থেকেই মূলত অভিনয়, গল্প, উপন্যাস ও অন্যান্য শিল্প এসেছে। সম্ভবত এজন্যই বলা হয়.. কবিতার সকল শিল্পের জননী।
অভিনয় থেকে এরপর আসলো যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক, একক অভিনয়। এগুলো আর কিছুই না, অভিনয়ের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা। তারপর আস্তে আস্তে শাখাগুলো বিকশিত হতে শুরু করল.. এবং সেগুলো শিল্পের আলাদা একটা ফরমেট হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। কবিতা রয়ে গেল কবিতার জায়গায়। যদিও তার বিভিন্ন ধরনের বাঁকবদলে বহুমাত্রিকতা এসে তার পুরো আঙ্গিক চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে.. কখনো সেটি গীতিকবিতায়.. কখনো চিত্রকল্পে.. কখনো কখনো বা বিদ্রোহে.. কিংবা রোমাঞ্চে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছে।
এর মাঝখানে অনেকগুলো মুভমেন্ট হয় ইউরোপে.. যেমন বিট জেনারেশন, হাংরি জেনারেশন, সুরিয়ালিজম ইত্যাদি। এই মুভমেন্টগুলোর ফলে কবিতা আরও কিছু নতুন আঙ্গিক পায়.. এবং নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। এগুলো আর কিছুই না.. আধুনিকতা এবং উত্তর আধুনিকতার কিছু পার্টিশন।
যদিও ইউরোপে অনেক আগেই আধুনিকতার বাতাস লেগেছে.. কিন্তু সেই বাতাস আমাদের এই অঞ্চলে আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে.. এর জন্য অবশ্য দায়ী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনার গীতিময় রোমান্টিক কবিতায় এদেশের মানুষ এত বেশি মগ্ন হয়েছিল যে.. এর বাইরে বাংলা সাহিত্য অন্য কোন রূপ তারা কল্পনাই করতে পারতেন না.. এবং অনেকে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হননি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্যের সূর্যস্বরূপ
ফলে কবিতার জন্য এটা একটা সংগ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছে.. কিভাবে রবীন্দ্রনাথের বলয় থেকে বের হয়ে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য তৈরি করে বাংলা সাহিত্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- সেইটাই তাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অল্প কয়েকজন কবি নিজেকে পরিচিত করতে পেরেছিলেন। তারপর আসলো তিরিশের দশক। এই সময় যদিও রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন.. কিন্তু এক ঝাঁক তরুণ উদ্যমী পরিশ্রমী এবং সময় সচেতন কবির পদচারণায় বাংলা কবিতা একটা ঝাঁকুনি খেলো.. এবং পাঠকেরা বুঝতে পারল যে- রবীন্দ্র ঘটনার বাইরে গিয়েও বাংলা সাহিত্যে খুব একটা বড় পরিসর আছে.. সেটা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। শুরু হতো আধুনিক কবিতার জয়যাত্রা। এবং এর পেছনে প্রধান নিয়ামক ছিলেন পাচজন বিশিষ্ট কবি.. যাদেরকে পঞ্চপান্ডব বলে আখ্যায়িত করা হয়.. জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তী।
তাদের মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী কবি হিসেবে পরবর্তীতে চিহ্নিত হন এবং চর্চিত হন.. যদিও নিজস্ব সময়ে তিনি কিছুটা বঞ্চিত ছিলেন এটা নিয়ে আমি এর আগে একটি লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি: জীবনানন্দ দাশ, একজন অভিশপ্ত দেবদূত..
তবে ত্রিশের দশকের একটা বড় সমস্যা ছিল.. তারা আধুনিকতা বলতে শুধুমাত্র ইউরোপিয়ান সাহিত্যের আধুনিকতা বুঝতেন। কেউ কেউ অবশ্য ভিন্ন আঙ্গিকে চেষ্টা করেছেন- আধুনিকতাকে এ দেশের সাথে খাপ খাইয়ে একটা ফিউশন তৈরি করতে.. কিন্তু ঘুরে ফিরে তাদের কবিতায় প্রকরণ এবং উপকরণ হিসেবে ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল।
সেটা কাটিয়ে উঠতে পরবর্তী চল্লিশ দশক ব্যর্থ হয়েছে। বলা যায়- এ কারণে চল্লিশ দশকে খুব বেশি প্রভাবশালী কবি দেখা যায় না। যদিও আহসান হাবিব, ফররুখ আহমেদ.. তাদের মত কয়েকজন কিছুটা প্রভাব রেখে গেছেন.. কিন্তু সেটা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
এরপর পঞ্চাশ দশকে তিন জন বিশিষ্ট কবির কাব্য প্রতিভায় বাংলা সাহিত্য তার গতিপথ যেন ফিরে পেল.. এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা যেন তারা অংকন করলেন। তারা তিনজন হলেন.. বিশিষ্ট কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এবং শহীদ কাদরী। এসময় আরও অনেক কবি ছিলেন.. কিন্তু এই তিনজনের প্রভাব এবং প্রতিভার তুলনায় অন্যরা খুবই নগণ্য।
পঞ্চাশ দশকের প্রধান তিন কবি: শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ
শামসুর রাহমান মূলত শহুরে উপকরণ নিয়ে কবিতা লিখতেন.. যার কারণে তাকে নাগরিক কবি বলা হয়। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের কিছু অসাধারণ কবিতা লেখার কারণে তাকে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। আর আল মাহমুদের বিশিষ্টতা ছিল লোকজ শব্দের সুনিপুণ প্রয়োগ করে বাংলা সাহিত্য শব্দের ভান্ডার সমৃদ্ধ করা.. এবং তাতে মাটির গন্ধ এনে দেওয়া। যে কারণে তার কবিতা অনেক বেশি জীবন্ত এবং প্রাণবন্ত মনে হতো.. এখনো হয়।
শহীদ কাদরী অনেক বেশি জীবন নির্ভর কবি ছিলেন। কিন্তু তিনি যেরকম রাজসিক ভাবে সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন.. এবং তিন তিনটি পরপর অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ রচনা করে নিজের পদধ্বনি জানান দিয়েছিলেন.. সেটি স্থগিত হয়ে যায় হঠাৎ করে তার স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যাওয়ায়। কি কারণে তিনি প্রবাসী হয়েছেন.. সেটা আজও জানা যায়নি। সম্ভবত কোন একটা আক্ষেপ অথবা অভিমান নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন.. এবং সেই সময় তিনি মূল ধারার সাহিত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। এমনকি খুব বেশি লেখালেখিও করেন নি। অল্প যা কিছু লিখেছেন.. সেগুলোতে আর আগের মান পাওয়া যায়নি।
এরপর ষাট ও সত্তর দশকের এক ঝাঁক প্রতিভাবান কবি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে আধুনিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তারপর থেকে পরবর্তী কবিরা আবার দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু করে উত্তর আধুনিকতা নিয়ে। তারা যেন আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতাবাদের সম্মেলন নিয়ে দ্বিধায় ভুগতে থাকেন.. যার ফলে তাদের লেখায় সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তী সময় গুলোতে কবিতা অনেকটাই পাঠক বিমুখ হয়ে যায় এবং হয়ে ওঠে শুধুমাত্র কবিদের জন্য। যে কারণে- আগে মানুষ যেভাবে কবিতার বই কিনে পড়ত.. পরবর্তী দশকগুলোতে সেটা দেখা যায় না।
এখন খুব অল্প কিছু মানুষ- যারা গভীরভাবে সাহিত্য বোঝে.. অথবা সাহিত্যচর্চা করে.. অথবা আবৃতি , নাটক ইত্যাদি অন্য কোন ফরমেটের সাথে জড়িত আছে.. শুধুমাত্র তারাই কবিতা পড়ে। কিন্তু যারা শিক্ষিত সাধারণ জনগণ, তারা বই কিনে কবিতা পড়তে খুব একটা দেখা যায় না।
মোটামুটি সংক্ষেপে বললে, এই হলো কবিতা এবং বাংলা কবিতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পরবর্তীতে আশাকরি আধুনিকতাবাদ ও উত্তর আধুনিকতাবাদ নিয়ে বিস্তারিত লিখব। আজ এ পর্যন্তই থাক।
সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
আমার পরিচিত:
আমি কাব্য.. কবিতা এবং সাহিত্য ভালোবাসি.. নিজেও কিছু লেখার চেষ্টা করি.. হয়, আবার হয় না..