ছোটবেলা থেকেই একটা শব্দ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা । মাঝে মাঝে ভাবি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জিনিসটা কি?
কি কারনে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে এইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছি ল তখনকার পৃথিবীর অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে?
তারা জানত, যে কোনো সময় যুদ্ধে তারা মারা যেতে পারে। একটা মানুষ যখন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এগিয়ে যায়, তখন তার মনের মধ্যে কি কাজ করে?
কেন সে জীবনকে পরোয়া করে না.. মৃত্যুকে পরোয়া করে না.. পরিবারের ভালোবাসা.. সন্তানের মুখ.. এগুলো সব পেছনে ফেলে অসীম সাহসে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যায় মৃত্যুর দিকে..?
আসলে তৎকালীন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম নিপীড়নে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর পঁচিশে মার্চের কালো রাতে যেভাবে তারা হামলা করেছিল, সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ছিল।
এছাড়াও ছিল তৎকালীন শাসকদের অত্যাচার। পূর্ব পাকিস্তান - পশ্চিম পাকিস্তান বৈষম্য দেশভাগের পর থেকেই দেখে এসেছি আমরা।
দীর্ঘদিন পর জনগণ যখন নতুন স্বপ্ন নিয়ে, দেশ গড়ার আশা নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভোট দিয়ে জয় যুক্ত করেছিল, বিপুল ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সেই সরকারকে ক্ষমতা না দিয়ে গড়িমসি করছিল সামরিক সরকার। আর তাতে ইন্ধন দিচ্ছিল পাকিস্তানের কিছু রাজনীতিবিদ।
গ্রামের একজন কৃষক.. শহরের একজন কুলি.. সে তো রাজনীতি বোঝে না। সে বোঝে ভাতের নিশ্চয়তা.. সে বোঝে পরনের কাপড়ের নিশ্চয়তা.. মাথার উপর একটু ঠাই এর নিশ্চয়তা..
এগুলো যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন তো তার বেঁচে থাকার আর কোন আশা ভরসা অবশিষ্ট থাকে না। তখন সে - হয় মরবো.. না হলে লড়বো.. এবং অধিকার আদায় করব.. এরকম একটা চেতনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
আজকে যখন স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা মুক্তবাতাসের নিঃশ্বাস নিচ্ছি, তখন আমরা কতটুকু উপলব্ধি করতে পারছি সেই মুক্তিযোদ্ধার চেতনা?
সত্যিই যদি উপলব্ধি করতে পারতাম, তাহলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম সারিতে থাকতো না। যদি সত্যি উপলব্ধি করতে পারতাম, তাহলে সমাজে এত অন্যায়.. অত্যাচার.. অবিচার.. রাহাজানি.. ধর্ষণ.. থাকতো না।
এগুলো আছে- কারণ আমরা সেই কৃষকটার চেতনা ভুলে গেছি, যে তার সদ্যোজাত সন্তানের কান্নার শব্দগুলো পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল।
আমরা সেই মজুরের চেতনা ভুলে গিয়েছি, যে তার নবপরিণীতা স্ত্রীর মেহেদি রাঙা হাতে হাত রেখে শেষবিদায় নিয়ে সেই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল..
আমরা ভুলে গেছি সেই সদ্য যুবক ভার্সিটিপড়ুয়া ছেলেটির কথা, যে তার শিক্ষাজীবন আর বৃদ্ধ বাবা মায়ের স্বপ্ন একপাশে ঠেলে রেখে রাতের আধারে চলে গিয়েছিলো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে..
আমরা ভুলে গিয়েছি সেই অসুস্থ মায়ের কথা, যে তার একমাত্র ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধ করতে নিজের কথা চিন্তা না করে..
আজ আবার সেই চেতনাগুলো জাগিয়ে তোলা দরকার। যে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সে অন্যায় অবিচার নতুন রূপে বারবার ফিরে ফিরে আসছে।
কবির ভাষায় বললে:
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি
ধর্ষিতার চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতর..
বেঁচে থাকলে হয়তো এর চেয়েও মর্মভেদী কবিতা লিখেতেন রুদ্র।
আবার সেই চেতনা কি জাগিয়ে তুলতে পারি না? যদি একবার সেই চেতনা নবপ্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করা যেত, তাহলে হয়তো আমরা নতুন আরেকটি বিপ্লব সংঘটিত হতে দেখতাম- সোনার বাংলা গড়ার বিপ্লব.. ক্ষুধামুক্ত দারিদ্রমুক্ত দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিপ্লব..