আমাদের দেশের বাচ্চারা বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা ছোটবেলায় যে খেলাটা বেশি বেশি খেলে, সেটা হল পুতুল খেলা। এটি খেলেনি শৈশবে, এমন মানুষ মনে হয় কমই আছে আমাদের দেশে..
পুতুলের আবার বিভিন্ন ক্লাসিফিকেশন আছে। আগের দিনে গ্রামদেশে কাপড়ে বানানো অথবা মাটির বানানো পুতুল দিয়ে খেলত বাচ্চারা। দেখা যেত যারা মেয়ে শিশু, তাদের কাপড়ের পুতুল দিয়ে খেলার প্রবণতা বেশি ছিল। তুলনামূলক ভাবে পুরুষ শিশুরা মাটির তৈরি পুতুল দিয়ে খেলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত।
এখন শিল্পায়নের কারণে এবং যুগের পরিবর্তনে পুতুলের মধ্যেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখন বাজারে বিভিন্ন ধরনের রং বেরঙ্গের পুতুল পাওয়া যায়। এর মধ্যে কাপড়ের, প্লাস্টিকের, ধাতব ইত্যাদি পুতুল বেশি দেখা যায়। সাধারণত বর্তমানের মেয়ে শিশুরা কাপড়ের তৈরি পুতুল দিয়ে বেশি খেলে যেমন টেডি বিয়ার অথবা স্নো হোয়াইট। ছেলে শিশুদের সাধারণত দেখা যায় মেটাল অথবা প্লাস্টিকের বিভিন্ন সুপার হিরোদের পুতুল দিয়ে খেলতে।
এছাড়াও বর্তমানে পুতুলের ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো রোবট পুতুল। ব্যাটারি চালিত নাড়াচাড়ায় সক্ষম রোবট বর্তমানে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর কিছু কিছু আছে ব্যাটারি লাগিয়ে সুইচ দিলেই নড়ে ওঠে। আবার কিছু কিছু আছে রিমোট চালিত। এই রিমোট চালিত পুতুলগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে একটু বেশি হয়ে থাকে।
এছাড়াও বিভিন্ন প্রাণীর এবং এলিয়েনদের পুতুলও বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন এনিমেশন মুভির চরিত্র অথবা মুভির বিভিন্ন কারেক্টার নিয়েও পুতুল বানানো হয়।
এবার আসি পুতুল বিষয়ক মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায়। একটি শিশু যখন পুতুল দিয়ে খেলে, তখন তার মনস্তত্ত্বে এর একটা প্রভাব পড়ে। এই প্রভাব পজিটিভ অথবা নেগেটিভ হতে পারে। প্রথমে পজিটিভ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি।
মেয়েরা সাধারণত পুতুল খেলায় পরিবার, পরিবার খেলে। আর ছেলেরা যুদ্ধ, যুদ্ধ খেলে। মেয়েরা পুতুলের বিয়ে, বাচ্চা খেলতে খেলতে পরিবারের প্রতি তাদের টান তৈরি হয়। যার ফলে বাংগালী মেয়েরা স্বভাবতই একটু বেশি স্নেহময় হয়।
আরেকটা ভালো দিক হল, শিশুদের কল্পনাশক্তি বাড়ে। তারা পুতুলের পরিবার, যুদ্ধ খেলা কল্পনা করতে করতে এক অন্য জগতে চলে যায়। তাদের অন্তরের চিন্তা শক্তি জাগ্রত হয়। এই চিন্তা শক্তি তাদের মেধা ও মননের বিকাশ তরান্বিত করে।
এছাড়াও পুতুল খেলা যেহেতু একটা সুস্থ বিনোদন, তাই এটাতে ব্যস্ত থাকায় তারা অন্য ক্ষতিকর বিনোদন থেকে নিরাপদ থাকছে।
এতগুলো পজিটিভ প্রভাব থাকলেও এর কিছু নেগেটিভ দিক আছে। যেমনঃ কিছু কিছু বাচ্চা বিশেষত যারা মা-বাবা কিংবা অন্য কোন বাচ্চার সান্নিধ্য কম পায়, তারা এসব খেলার জগতে এত বেশি ডুবে যায় যে সেই জগতকেই একসময় সত্য বলে মনে করতে শুরু করে। এটা অটিজমের একটা বিশেষ প্রকার। তারা তখন কল্পনা ও বাস্তবের পার্থক্য করতে পারে না।
এর একমাত্র সমাধান হল পারিবারিক জীবন যাপন করা। এটা পুতুল খেলা ছাড়াও হতে পারে, হয়ও। বরং মোবাইল, টিভি, কার্টুনের আসক্তিতে এই প্রবলেম বেশি হয়। যদি পারিবারিক সময় বেশি কাটায়, শিশুদের মানসিক গ্রোথ ভালো হয়। তখন এই প্রবলেম হবে না।
আরেকটা প্রবলেম হল, এখনকার স্পেশাল রবোটিক পুতুলের দাম কখনো কখনো অনেক বেশি হয় যা সবার সাধ্যের মধ্যে থাকে না। ফলে একটা শিশু যখন অন্য আরেকটা শিশুর কাছে দামী এরকম খেলনা দেখে, কিন্তু তার নিজের সেটা নেই- সে তখন এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। এটা তার ব্যক্তিত্বেও প্রভাব ফেলে।
যা-ই হোক, ভালো মন্দ সব কিছুরই আছে। আবার সব ভালো বা সব মন্দ সবার উপর সমানভাবে ক্রিয়া করে না। এগুলো মাথায় রাখলে হাজার বছরের ঐতিহ্য এই পুতুলখেলার যে ক্রমাগত বিবর্তন হতে হতে এখনো আমাদের সমাজ ও সভ্যতায় টিকে আছে, তার উপযুক্ত স্বীকৃতি দিতেই হয়।
পুনশ্চঃ দুষ্ট লোকেরা বলে, মেয়েরা পুতুল নিয়ে খেলতে খেলতে বেড়ে উঠে বলেই- বড় হয়ে ছেলেদেরকে পুতুল নাচ নাচিয়ে ছাড়ে। দুষ্ট লোকের কথায় কান দেবেন না। পুতুল খেলা ছেলেরাও খেলে।