বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক || সমস্যাবলী ও উত্তরণে করণীয়

in BDCommunity4 years ago

20200707_194132.jpg

একজন শিক্ষক হিসেবে দেশের কোন স্তরের শিক্ষককে যখন বঞ্চিত হতে দেখি, তখন খুব কষ্ট পাই। এদেশের সব থেকে নিগৃহীত শিক্ষক সমাজ সম্ভবত বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকবৃন্দ। তাদের সমস্যাবলী এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আমার আজকের আলোচনা: বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক, সমস্যাবলী ও উত্তরণে করণীয়।


বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়- দেশের বৃহত্তম, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৮ লক্ষ।উচ্চশিক্ষার আলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ১৯৯৩ সাল হতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেসরকারি কলেজ গুলোতে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে পাঠদান চলমান।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত সময়ের ভ্রান্ত জনবল কাঠামো, নীতিমালা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের কারণে উচ্চশিক্ষার সুফল হতে বঞ্চিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। উচ্চ বেতন বহন করছে শিক্ষার্থীরা। ফলে অনেকে মাঝপথে ঝড়ে পড়ছে।

অপরদিকে বেতনহীন মানবেতর জীবনযাপন করছে শিক্ষকবৃন্দ। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় অনেক মেধাবী শিক্ষক খুঁজে নিচ্ছেন নতুন পেশা। বিপন্ন পথে উচ্চশিক্ষা!

সংশধোনাধীন জনবল কাঠামোতে কমিটির প্রথম সভায় বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনীহা ও কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারণে বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে- ১৯৯৫, ২০১০, ২০১৩ এবং ২০১৮-তে জনবল কাঠামো সংশোধন করা হলেও উচ্চশিক্ষার কান্ডারিদের প্রাণের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে সর্বদা। দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র বেতনে কিংবা বেতনহীন অবস্হায় লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা ও সরকারি নীতিমালা মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শতভাগ বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধা প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও সারাদেশে মোট বেসরকারি কলেজের ৯০% কলেজ কর্তৃপক্ষ তা অনুসরণ করে না।

সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষকদের বেতনের নাম করে গরীব ছাত্রছাত্রীদের নিকট হতে মাসে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে বেতন নেওয়া হলেও শিক্ষকদের বেতন বাবদ ৩-১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। এ স্বল্প বেতনে দুর্মূল্যের এই বাজারে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলে না হতভাগা শিক্ষকদের!

এখানেই শেষ নয়! অর্থ সংকটের অজুহাতে অধিকাংশ কলেজেই মাসের পর মাস সামান্য এই বেতন থেকে বঞ্চিত করা হয়।

images (12).jpeg

সূচনালগ্ন থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ এর অধিক বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স পাঠদানের অনুমতি প্রদান করা হয়। ২০১৫ সালে প্রায় ২৮৮টি বেসরকারি কলেজকে সরকারি ঘোষণা করা হলে বতর্মানে অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানরত বেসরকারি কলেজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১৫ টি।

দীর্ঘ আটাশ ধরে জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্তি ও এমপিওর দাবিতে শিক্ষকবৃন্দ বিভিন্ন সময় সভা, সমাবেশ, মানবন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করে।

অনার্স- মাস্টার্স র্শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিও প্রদানের পক্ষে বেশ কিছু যৌক্তিক বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হলো :

১৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কতৃক শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিওভুক্তির বিষয় বিবেচনা ও পর্যালোচনার নির্দেশনা প্রদান করা হয় ২০১৪,২০১৭,২০১৯ সালে। কিন্তু এ নির্দেশনার বাস্তবায়নে কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।

২৷ দশম জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১২ ও ১৩ তম বৈঠকে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির বিষয়ে দুটি সুপারিশ প্রদান করে। শিক্ষা মন্ত্রনালয় সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে উচ্চশিক্ষা স্তরের এই শিক্ষকদের বেতন বঞ্চিত করে রেখেছে ।

৩৷ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক দুজন মহাপরিচালক জনাব ফাহিমা খাতুন ২০১৫ সালে ও জনাব এস এম ওয়াহিদুজামান ২০১৭ সালে মহোদয়গণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকে বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিওভুক্তির জন্য সুপারিশসহ আর্থিক খরচ কত হবে তা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে চিঠি দেন । কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রনালয় সেই চিঠি আমলে না নিয়ে শিক্ষকদের বেতন বঞ্চিত করে রেখেছে।

৪। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয় ২০১৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয়কে বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের শিক্ষা নীতিমালাতে অন্তর্ভুক্তি ও এমপিওভুক্তির বিষয়ে মতামত চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় আজ অবধি উক্ত চিঠির কোন জবাব দেই নি।

৫৷ নিয়ম মোতাবেক বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরে ২০১৮ সালের পূর্বের শিক্ষকেরা ক্যাডার হতে গেছেন। এছাড়া নতুন জাতীয়করণকৃত কলেজগুলোর শিক্ষকরাও সুযোগ পেয়ে নন ক্যাডার হতে চলেছে । অথচ বেসরকারি কলেজের অনার্স মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকেরা সামান্য এমপিওভুক্তির সুবিধা পর্যন্ত পাচ্ছে না। কি বৈষম্য!

৬৷ ১৯৯৩ সালের পরে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে সরকারি একক আদেশে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার জিবিজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ-সহ দেশের বেশ কয়েকটি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জনবল কাঠামোতে অনার্স-মাস্টার্স স্তর অন্তর্ভুক্ত না করায় অন্যান্য কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা যুগের পর যুগ ধরে বেতন বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ।

৭৷ বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকবৃন্দের মত অনুরূপ পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিগ্রী কোর্স-এর তৃতীয় শিক্ষকদের মধ্যে যারা ২০১০ সালের পূর্বে নিয়োগপ্রাপ্ত তারা এমপিওভুক্ত হইয়েছে। ২০১০ সালের পরে নিয়োগকৃতদের এমপিও প্রদানও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অথচ উচ্চশিক্ষা দানে নিয়োজিত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের বারবার শিক্ষা মন্ত্রনালয় উপেক্ষিত করেছে।

৮৷ মাদ্রাসা পর্যায়ের বেসরকারি ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসার শিক্ষকবৃন্দেরও এমপিও প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ একই পর্যায়ে শিক্ষা প্রদান করলেও বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকেরা দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে জনবল কাঠামো ও এমপিও হতে বঞ্চিত রয়েছে ।

৯৷ কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স স্তরে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । কিন্তু সে সকল শিক্ষকেরাও বেতন বঞ্চিত।

১০৷ একই এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে যেখানে ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রী শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত হতে পারেন, সেখানে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা তাদের চেয়ে বেশী পরিশ্রম করে কেন এমপিও বঞ্চিত থাকবে?

১১৷ সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার যখন সকল স্তরে শিক্ষা সুবিধা ফ্রি করে দেওয়া কাজ করছে, সেখানে উচ্চশিক্ষা স্তরে বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের নিকট হতে উচ্চ মাত্রায় এভাবে বেতন আদায় করা কতটা যৌক্তিক?

১২৷ শিক্ষার্থীদের নিকট হতে অধিক হারে বেতন আদায়ের পরেও শতভাগ বেতনের কথা উল্লেখ করে নিয়োগ দানের পর শিক্ষকদের মাসে মাত্র ২০০০-১০০০০ টাকা (কলেজ ভেদে) বেতন দেওয়া কতটা মানবিক?

১৩৷ একই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেখানে ডিগ্রী স্তরে ২১ বিষয় পাঠদানের জন্য শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারে ৩ জন। অন্যদিকে অনার্স স্তরে ৩০ টি বিষয় পাঠদান করেও একজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারে না। যা সবচেয়ে অমানবিক বিষয়।

১৪৷ বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ৫০০-১৫০০ টাকা আর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ২৫ টাকা। এক দেশে দ্বৈত নীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন বৈষম্য থাকলে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ কিভাবে সম্ভব?

১৫৷ একই ছাত্র, বই, সিলেবাস, পরীক্ষা, খাতা দেখা ও একই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষক হয়ে কেউ সরকারি হবে, আর কেউ নূন্যতম বেতন পাবেন না... এটা হতে পারে না ।

বঞ্চনার এই কারণসমূহ বিশ্লেষণ করে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি অতীব জরুরী। এছাড়া চলমান করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষকেরা অত্যন্ত কষ্টে দিন অতিবাহিত করছে।

তাই উচ্চ শিক্ষাদানে নিয়োজিত এই সকল শিক্ষকদের হৃদয়ের বোবা কান্না উপলব্ধি করে তাদেরকে অনতিবিলম্বে সংশোধনাধীন জনবল কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করে এমপিও প্রদান এখন সময়ের দাবি।

images (9).jpeg