ছোট বাচ্চারা নাকি স্কুলে যেতে চায় না। এটা একটা কমন অভিযোগ অভিবাবকদের। কিন্তু করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলি বন্ধ থাকায় ওরাও মনক্ষুন্ন। এর প্রমাণ পেলাম আমার ভাগ্নি আফরাকে দেখে।
সে একটি মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। মাদ্রাসায় একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি হিফজও করানো হয়। ফলে তাদেরকে দুই বেলা যাওয়া লাগে। সকালে একাডেমিক ক্লাস হয়। দুপুর পর্যন্ত। সন্ধ্যায় হিফজ।
যদিও আনন্দমুখর পরিবেশে পড়ানোর চেষ্টা করা হয়, তবু মাঝে মাঝেই সে মাদ্রাসায় যেতে চায় না। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে ওদের মাদ্রাসা বন্ধ।
এখন অনলাইনে ক্লাস হয়। পরীক্ষাও অনলাইনে। জুম অ্যাপ ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনলাইন ক্লাসে কি আসল ক্লাসের মজা পাওয়া যায়? একজন আরেকজনকে কলম দিয়ে খোচা দেওয়া, বই লুকিয়ে ফেলা, ছোটাছুটি করা.. সেই মজা তো আর অনলাইন ক্লাসে নেই।
সেদিন দুপুরে আফরা এসে বললোঃ আজকে কি নিয়ে লেখবো?
আমি বললামঃ তোমার মাদ্রাসা নিয়ে লেখো।
সে লিখতে শুরু করলো।
আফরা যদিও ক্লাস ওয়ানে পড়ে, আমি চাচ্ছি- সে যেন শুধু মুখস্ত বিদ্যার মধ্যে আটকে না থাকে। একটা বাচ্চার চিন্তার জগৎ প্রসারিত হয় কল্পনার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কল্পনার জায়গাটা রাখেনি।
বর্তমানে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাচ্চাদেরকে কেবল মুখস্ত করা শেখানো হচ্ছে। তাদেরকে কিছু প্রশ্ন মার্ক করে দেওয়া হয়। কিছু কিছু নোট দেয়া হয়। সেগুলো থেকেই পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে। ওরা সেগুলো বুঝ না বুঝে কেবল মুখস্ত করে। এবং সময় মত পরীক্ষার হলে সেগুলো উগড়ে দেয়।
কিন্তু এতে তাদের চিন্তা শক্তি বিকশিত হচ্ছে না। যার ফলে প্রতিবছর আমরা ভালো রেজাল্ট করা এক ঝাঁক মেধাবি শিক্ষার্থী পাচ্ছি। তারা ভালো এমপ্লয়ী হচ্ছে, এমপ্লয়ার হচ্ছে না। সৃজনশীল কাজের জগৎটায় তারা ব্যর্থ হচ্ছে।
এজন্য আমি যখনই সুযোগ পাই- ছোট বাচ্চাদেরকে চিন্তা করার অপশন দিতে চাই। যেহেতু আমার ভাগ্নি আফরা এখন বাসায় বসে আছে, পড়াশোনার চাপ কম, তাকে আমি বলেছি- প্রতিদিন একটা করে রচনা লিখতে।
প্রথম শ্রেণীর ছাত্রীর জন্য রচনা লেখাটা যথেষ্ট কঠিন। সে জিজ্ঞাসা করলঃ রচনা কি?
বললামঃ রচনা মানে হচ্ছে- কোন একটা বিষয় নিয়ে তুমি মনের ইচ্ছা মতো লিখবে।
আমি প্রতিদিন তাকে একটা করে বিষয় নির্ধারণ করে দেই, আর সে আমাকে ১০-১২ লাইন লিখে দেয় তার লেখা দেখে আমি মাঝে মাঝে চমৎকৃত হয়ে যাই।
হয়তো পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণির কোন শিক্ষার্থীকে লিখতে দিলে সে এই রকম ইনফর্মাল রাইটিং লিখতে পারতো না। কারন তারা একটা নিয়মের মধ্যে লিখতে লিখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু ক্লাস ওয়ানের স্টুডেন্ট- যে জানে না রচনা লেখার নিয়মকানুন, মনের আনন্দে লিখে। সে কোন টেমপ্লেট রাইটিং-এর ধার ধারে না। যা মনে আসে, যেভাবে মনে আসে- তা সেভাবে লিখে ফেলে।
এর ফলে তিনটি লাভ হচ্ছে-
এক, তার চিন্তা করার সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে, কল্পনার জগত পরিব্যপ্ত হচ্ছে এবং সৃজনশীল মানস গঠিত হচ্ছে।
দুই, লিখতে লিখতে তাঁর লেখার হাত ভাল হচ্ছে। শব্দভাণ্ডার, বাক্য গঠন এবং লেখার অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সে লিখতে লিখতে শিখে যাচ্ছে।
তিন, তার অবসর সময়টা ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এই সময় হয়তো সে খেলত অথবা দৌড় ঝাপ দিত। কতক্ষণ আর খেলতে ভালো লাগে? এই যে, কিছু সময় সে লিখার পিছনে ব্যয় করছে। এতে তার দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যেও একটা বৈচিত্র আসছে এবং সে বিষয়টা এনজয় করছে। পড়াশোনাটা তার কাছে আরো উপভোগ্য হয়ে উঠছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মাদ্রাসা নিয়ে তাকে লিখতে বলার মাত্র ১২ মিনিটে লেখা শেষ করে ফেললো।
আমি ভেবেছিলাম, সে হয়তো গতানুগতিক টেমপ্লেট রাইটিং লিখবে- যেমনঃ আমার মাদ্রাসার নাম.. আমি অমুক ক্লাসে পড়ি.. আমার রোল এত.. আমার টিচাররা খুব ভালো.. ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু তার লেখাটা ছিল গতানুগতিকতার বাইরে। সে একেবারে ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে মনের ভাব প্রকাশ করেছে। এটাই আমাকে বেশি চমৎকৃত করেছে। লিখেছে-
"করোনা, ও করোনা, যাবে কখন? আমার মাদ্রাসা- তারে কতদিন দেখি না। যেতেও পারি না। অনলাইনে ক্লাস করতে করতে আর মজা পাই না। করোনা, যাবে কবে। সে দিনই আমার প্রাণ ভরে হাসি যাগবে। আমার মাদ্রাসা ছেড়ে দিবো না। তাকে আমি কত ভালবাসি। করোনা, ও করোনা, তুই যাবি কখন? আহা মাদ্রাসা তুই আমার প্রিয় মাদ্রাসা। আমি তোরে কত ভালবাসি।"
আমার মনে হয়, বাচ্চাদেরকে এইভাবে চিন্তার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। তাদের রেজাল্টের দিকে বেশি ফোকাস না দিয়ে, তাদের মানস গঠন এবং মেধা বিকাশকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
আত্মকথনঃ
আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।
- Hive: My Blog
- LeoFinance: My Leo
- Dtube: My Tube
- 3speak: My Vlog
- Twitter: My Tweet
- FB: My Profile
- Pinmapple: My Tour
- TravelFeed: My Feed
"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"
জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি