গল্প: আত্মহনন এবং নিম্নবিত্তের দিনলিপি..

in BDCommunity4 years ago (edited)

images (3).jpeg

বাবলু মিয়া ঘোড়ার গাড়ি চালায় সদরঘাটে। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট। একবার ভাড়া মারলে আড়াইশো টাকা উঠে। এর মধ্যে মালিকরে দিতে হয় দেড়শ টাকা। হেল্পার পিচ্চিটাকে দিতে হয় ৫০ টাকা.. আর তার থাকে ১০০ টাকা। দিনে ৫-৭ বার ভাড়া মারতে পারে। এর বেশি সিরিয়াল পেতে কষ্ট হয়। এই রুটে প্রায় ১০০ টার মত ঘোড়া আছে, সব মিলে পঞ্চাশটার মত গাড়ি চলে।

চার মাস থেকে ইনকাম বন্ধ। গাড়ি চলে না। যদিও লকডাউন এর মধ্যে বড় বড় সাহেবদের দামী দামী গাড়ি রাস্তা দিয়ে ঠিকই সাঁই করে চলে যায়। পুলিশ সেগুলো ধরেও না। ধরে শুধু তাদের গরীবের গাড়ি।

কিছু জমানো টাকা ছিল। সেগুলোও ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেয়ে ফেলেছে। একটা স্বর্ণের চুড়ি ছিল বউয়ের। বিয়ের সময় সখ করে কিনে দিয়েছিল। সেটাও বিক্রি করে এই কয়েকদিন চলেছে। এখন আর বিক্রি করার মতোও কিছু নেই।

অন্য সময় কোন কারণে রাস্তা বন্ধ থাকলে, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলে, অন্য কোন কাজ করে সংসার চালাত। এখন তো সেই সুযোগ নেই। কাজকর্ম সব বন্ধ। অনেক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে, বাজার করার পয়সা না পেয়ে.. স্বপ্নের শহর ঢাকা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে তাদের গ্রামে খালি হাতে।

কিন্তু বাবলু মিয়ার সেই সুযোগও নেই। গ্রামে যা কিছু ছিল ভিটেবাড়ি, সেই কবে বিক্রি করে চলে এসেছে শহরে। ঢাকা শহরে নাকি টাকা উড়ে। ধরার চেষ্টা করেছে। পারেনি। সবাই পারে না। সবাইকে দিয়ে সব হয় না।

অবশ্য সে নিজেও ঢাকায় উড়তে দেখেছে টাকা। তার সাথেই কাজ করতো টেরা রাশেদ। এখন সে এলাকার পাতি মাস্তান। টাকা যেন বানের জলের মতো আসে তার কাছে।

বাবলুকে কয়েকবার বলেছে। হয়তো এক সময়ের বন্ধু বলেই তার জন্য কিছুটা সহানুভূতি টেরা রাশেদের আছে। তাকে প্রস্তাব দিয়েছে অনেকবার। কাজ তেমন কঠিন কিছু না শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছোট্ট একটা প্যাকেট পার করতে হবে।

images (6).jpeg

এই প্যাকেটগুলোর ভেতরে নাকি অমূল্য কিছু জিনিস আছে। যেগুলো বড়লোকের ছেলে মেয়েরা পুড়িয়ে নেশার জগতে ভেসে যায়। কয়েকবার বাবলুর মনে হয়েছিল- শুরু করি। কি আর হবে? আমিতো খাচ্ছি না! যারা খায়, তারা তো যে করেই হোক জোগাড় করে খাবে..। আমি না করলে অন্য কেউ কাজটা করবে। এরকম অসংখ্য যুক্তি তাকে প্ররোচিত করছিল।

কিন্তু সে পারে নি বউয়ের জন্য। তার বউ সখিনা। এক আশ্চর্য সরল মহিলা। খুব বেশি লেখাপড়া নাই। কিন্তু অদ্ভুত রকমের দৃঢ়তা এবং সততা তার মাঝে। তাকে বলতেই সে কি ক্ষিপ্রতার সাথে না করে দিল!

ছেলের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল- আমাদের রাজুর কসম লাগে, এই কাজে আপনি যাইয়েন না। চিন্তা করে দেখেন, রাজু বড় হইতেছে.. আর কয়েক বছর পরে সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিব.. কত জায়গা যাইবো..। আপনার এই কাজের অভিশাপে যদি আমাদের রাজু কোনদিন নেশায় জড়াইয়া যায়, আপনি মাইনা নিতে পারবেন?

এই কথার পরে আর এগুনো যায় না। তাই সে রাশেদকে না করে দিয়েছে। রাশেদা তাকে টিটকারী মেরে বলেছিল- তুই থাক তোর নীতি লইয়া.. যেদিন না খাইতে পাইয়া আমার পায়ের উপর আইসা পরবি, সেদিন তোর এই নীতি কথাগুলো তোরে ফিরাইয়া দিমু..

এখন এই অভাবের দিনে মাঝে মাঝে মনে হয়, তার পায়ের উপর কি পড়ে। কিন্তু গরিব হলেও কিছু কিছু মানুষের আত্মসম্মানবোধ থেকে যায়। সেই আত্মসম্মানবোধের কারণে তারা সারা জীবন না পারে কিছু করতে, না পারে কারও পায়ের উপর পড়তে।

বাজারে গেল বাবলু মিয়া। তরকারির দাম জিজ্ঞাসা করল। তারপর পকেটে হাত দিল। পকেটে কয়ে খুচরা টাকা আর পয়সা। ওটা দিয়ে তরকারি তো দূরের কথা, তরকারির খোসাও পাওয়া যাবে না। বাজারের এক পাশে হাতের থলেটা বিছিয়ে বসে পড়ে সে। তারপর সুর করে করে বলতে শুরু করল- দুইটা টাকা দিয়া যান, আমি গরীব ইনসান

images (4).jpeg

জীবনে কখনো মানুষের কাছে হাত পাতে নি। তবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ ভিখারিদের করুন সুরে গান গেয়ে ভিক্ষা করতে দেখেছে। সেও চেষ্টা করল ওই ভিখারিদের মত কাকুতি-মিনতি মিশ্রিত করুন কণ্ঠস্বর ফুটিয়ে তুলতে। কিন্তু করোনার কারণে মানুষ যেন দান করতেও ভুলে গেছে।

এখানে কয়েক ঘন্টা বসে থাকার পরে কয়েকটা আধুলি, সিকি পয়সা ব্যাগের উপর চকমক করছে। বাবলু মিয়ার চোখে পানি চলে আসলো। তার কানে ভাসছে কাল রাতে ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাচ্চাটার কান্নার শব্দ। তার সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে: হয় টেরা রাশেদের পায়ের উপর গিয়ে পড়া, অথবা...

বাবলু মিয়া ঠিক করে ফেলেছে, দ্বিতীয় পথে আগাবে। সে উঠে দাঁড়ালো। বাজারের থলেটা গুছিয়ে ধীরে ধীরে ধীরে সামনের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল..

  • ভাই আমারে শক্ত দেখে এক গাছি দড়ি দেন, কত টাকা?

20200627_034755.jpg


আত্মকথনঃ

poster_1593196763985_rd7uzi0du0.gif

আমি ত্বরিকুল ইসলাম
সখের বশে ব্লগিং করি।
Hive: @tariqul.bibm
Dtube: My Channel
3speak: My Vlog
Twitter: Tariqul Islam
Pinmapple: My Travel

"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"

        জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি
Sort:  

ফিনিশিং টা অস্থির ছিল। তবে প্রকৃত সত্য ঘটনা তুলে ধরেছেন । সময় তো সাধারণ মানুষের পক্ষে নাই ।😞

সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্ত খুবই কষ্টে আছে। আশা করি এই দুরাবস্থা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে আবার বাংলাদেশ জেগে উঠবে।

আপনার লিখা
খালি হাতে পড়া যায় নাহ তো! তাই চা বানালাম, দুধ চা!চা-পাতি একটু বেশি গরম করেছি যাতে বেশিক্ষন যাবৎ খাওয়া যায়।আপনি সাধারণত দীর্ঘ লিখেন তাই এ আয়োজন।
লেখা পড়ে ভালো লাগলো ভাই।তবে গত লিখাগুলোর তুলনায় আকারে ছোটো হলেও অনেকটা এয়ারেকশানের মতন তাড়াতাড়ি ধরে।
আপনার লিখার প্রতি আমার শুধু শুভকামনাই থাকবে।

বড় লেখাগুলো লিখতে সময় লাগে প্রচুর। সব সময় এরকম অবকাশ পাওয়া যায় না। তাই ভাবছি, মাঝে মাঝে এরকম ছোট গল্পও দেব।

আপনার কমেন্টগুলা আমাকে সত্যিই প্রেরণা জোগায়।

Hi @tariqul.bibm, your post has been upvoted by @bdcommunity courtesy of @simplifylife!


Support us by voting as a Hive Witness and/or by delegating HIVE POWER.

20 HP50 HP100 HP200 HP300 HP500 HP1000 HP

JOIN US ON

একটা মানুষের উদাহরন দিয়ে, পুরা জাতির বর্তমান করুন পরিস্থিতি বর্ননা করলেন, শিক্ষক মশাই। চমৎকার ভাবে গল্পটাকে সাজিয়েছেন ভাই। আপনার লেখার বড় ফ্যান হয়ে গেলাম আজকে থেকে।

ধন্যবাদ আপনাকে। এরকম মন্তব্য পেলে লেখার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।

তা তো অবশ্যই ভাই, আমিও কিন্তু আপনার মতোই বাস্তববাদী গল্প লেখি। আমার লেখা সম্পর্কে আপনার মতামতটা আমার জানার দরকার, কারন আপনি একজন গুনি লেখক। যদি কখনো সময় হয়, আমার একটা লেখা পড়ে আপনার সঠিক বিচারটা জানাবেন, কৃতজ্ঞ থাকব।

অবশ্যই জানাবো। যারা লেখালেখি করে তাদের প্রতি আমার একটা অন্যরকম টান কাজ করে। তাদেরকে নিজের খুব আপন মানুষ মনে হয়। আর আপনি তো আমার সেক্টরের মানুষ। আমার একেবারে নিজস্ব লোক।

ধন্যবাদ ভাই।

অসাধরণ করুন পরিনতি।

আত্মসম্মানবোধ টা কারো কারো কাছে সবচেয়ে অমুল্য সম্পদ কিন্তু বর্তমান সমাজে এটি ধরে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।

যারা ধরে রাখছে, তাদেরকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আর দুঃখ জনক বিষয় হল, আমরা তাদের এই আত্মসম্মানবোধ কে বোকামি মনে করছি।

হ্যা একদম