গল্প: নেজাতুল্লার সোনার মোহর (লালব্রিজ হত্যাকাণ্ডের সত্যঘটনা অবলম্বনে)

in BDCommunity4 years ago

নেজাতুল্লা মারা গেছে। গরিবের মৃত্যু কাউকে বলে কয়ে আসে না। মাঠে সকালের কড়কড়ে রৌদ্রে কাজ করতে করতে নেজাতুল্লার মাথাটা হটাৎ চক্কর মেরে উঠেছিল, তাই সে খানিক বিশ্রাম নিতে উত্তরের ভিটায় এসে বটগাছটার ছায়ায় ঠেস দিয়ে বসে চোখ বুজেছিল মাত্র- সেই চোখ আর খুললো না!

নেজাতুল্লার মৃত্যুতে রজব কাঁদল না, কেবল মুখটা বিবর্ন পাংশুটে হয়ে চোখজোড়া যেন কোটর থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে শূন্য দৃষ্টিতে বটগাছটার দিকে চেয়ে থাকল। এই বাড়িতে বিলাপ করার কেউ নেই এক রজব ছাড়া। ক্রন্দনহীন মৃত বাড়িটা যেন ভূতুড়ে নীরবতায় ছেয়ে গেছে।

সবাই এসে এসে স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। শাহেন সর্দার রজবের কাঁধে হাত রেখে বললঃ বাপ মরি গেলে কাঁদতি হয় বাবা, কষ্ট চাপা দিয়ে রাখা ঠিক না। নেজাতের ভাগ্যি- বিষ্যুদবারে মরিছে। বড় ভালো লোক ছিল। তাড়াতাড়ি দাফন কাফন করাতি হবে। দেরি করলি আত্মা কষ্ট পায়।

শাহেন সর্দার নিজেই সব জোগার-যত্ন করল। পাঁচ কাতার জানাজা শেষে লাশটা দাফন দেয়া হল গ্রামের গোরস্থানে। দাফন শেষে ইমাম সাহেব লম্বা একটা মোনাজাত দিলেন। পয়-প্রতিবেশী অনেকেই ইমাম সাহেবের প্রার্থনার সকরুন বিবরনে আবেগে কেদেঁ ফেলল। রজব তখনো কাঁদল না। আকস্মিক শোক মানুষকে কখনো কখনো হতবুদ্ধ করে দেয়। ভেতরের চাপা অনুভুতিগুলোর বাহ্যিক প্রকাশ তখন স্তব্ধ হয়ে যায়।
20200715_001531.jpg

মোনাজাত শেষে যে যার যার মত কাজে চলে গেল। রজবকে হাত ধরে বাসার দিকে নিয়ে চলল শাহেন সর্দার। দাওয়ায় পিড়ি পেতে বসিয়ে খেতে দিল। রজব পান্তা ভাতের দিকে চেয়ে আছে। ক্ষুধা এমন এক জ্বালা- মৃত্যু মানে না, শোক মানে না, খানিক বাদে বাদে পেটে এসে কামুড় বসায়। তার ধারালো দাঁতে পেটের ভেতরটা কেটে কুটে খান খান হয়ে যায়!

শাহেন সর্দার তাড়া দিলে রজব পাতের দিকে হাত বাড়ায়। আঙ্গুল দিয়ে কড়কড়ে ঠান্ডা ভাতের দানাগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে। পেটে ক্ষুধার প্রকোপ কিন্তু গলার কাছে একটা বোবা কান্না যেন দলা পাকিয়ে আছে, সর্দার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই কান্নার দলাটা গলা উগড়ে বেড়িয়ে এল। স্বান্তনার আর্দ্র স্পর্শে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল রজব। চোখের পানি টপটপ করে পরছে আর পান্তা ভাতের মৌয়ের সাথে লোনা অশ্রু মিশে মিশে যাচ্ছে।

খাওয়া শেষে শাহেন সর্দার কাজের কথা পাড়লো। আরাম কেদারায় ঠেশ দিয়ে বসে দুই খিলি পান একসাথে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে জিহ্বার ডগা দিয়ে বাম চোয়ালের খাঁজে ঠেসে ধরে চিবুতে চিবুতে আরামে চোখ বুজেছে সর্দার। পানের রসে মজে ঝিম ধরে কিছুক্ষন বসে থেকে তারপর চোখ খুলে সরু চোখে রজবের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললঃ ‘মোহরের কথা কি ভাবিছো? কি করবা?’
images (6).jpeg

‘মোহর!’ –রজব যেন বুঝতে পারে না কিসের কথা বলছে সর্দার।

‘আসমান থিকা পরলা যেন! সিন্দুক ভরা যে মোহর রাখি গেছে নেজাত, এইবার তার একটা গতি করা লাগি যে। এই সম্পদে গ্রামের বেবাক লোকের হক আছে। গুপ্তধন বলি কথা, সরকারি লোক খবর পাইলে আইসা পুরাটাই লয়্যা যাবি।‘ রজব কিছু বলে না, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। বুঝতে পারে- একটা সূক্ষ্ম জালে সে আটকে যাচ্ছে। ছুটবার উপায় নেই।

‘কিরাম মোহর আছে ভিতরে, কয় ঘড়া?’ –সর্দারের চোখজোড়া মোহরের মত চকচক করে উঠে। সেদিকে তাকিয়ে রজবের চোখ ঝলসে যায়ঃ ‘জানি না চাচা। ভিতরে আসলে কি আছে কিছুই জানি না। আব্বা বাক্সডা কহনো খুলবার দেয় নাই। খালি বলতো- আমার মরার পর সিন্দুকডা খুলবি। আমার সারাজীবনের সম্পদের বিবরন আছে এর ভিতরে।‘

‘চলো গিয়া খুল্যা দেহি। দেরী করলি গ্রামের আর দশজন কানাঘুষা শুরু করবি, আইসা হক দাবী করবি।‘ –সর্দার ভুলায়ে ভালায়ে রজবকে রাজী করিয়ে ফেলে। রাজী না হয়ে অবশ্য উপায় নেই। নেজাত মারা যাওয়ার পর রজব এখন বানের জলে ভেসে আসা খড়কুটোর মত টলোমলো, সহায়-সম্বলহীন। সর্দার চাচার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাড়ানোর মত জোর তার শিরদাঁড়ায় নেই। দুজনে তাই যুগ যুগ ধরে আগলে রাখা নেজাতের সিন্দুকের রহস্য উদঘাটনে এই পড়ন্ত বিকেলে রওনা দিল।

নেজাতের বাড়ির চৌকাঠে যখন রজব আর সর্দার পা দেয়, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সূর্যটা তেলবিহীন সলতের মত নিভু নিভু আলো নিয়ে হঠাৎ ঘাপটি মেরে লুকিয়ে গেছে পশ্চিমের দিগন্তরেখায়। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা সঙ্গীত আর মাঝে মাঝে ব্যাঙের গুরু-গম্ভীর ডাক নীরবতাটাকে আরও উসকে দিচ্ছে! ঘরে ঢুকে রজব কুপিবাতি জ্বালালো। বাতির টিমটিমে আলোয় আন্ধার পুরোটা গেল না, তটস্থ হয়ে যেন ঘরের কোনে জবুথবু মেরে দাঁড়িয়ে থাকল।

রজব পালঙ্কের নিচ থেকে সিন্দুকটা টেনে বের করল। প্রাচীন কালের উঁচু পালঙ্ক। সিন্দুকটাও অনেক উঁচু, অনেক ভারী। টেনে বের করতে করতে রজব হাঁপিয়ে উঠেছে। জামকাঠের কালো ডালাটার উপর টেরাকোটা নকশা কাটা। নকশার খাঁজে খাঁজে ধুলার পুরু আস্তর জমে গেছে। ফুঁ দিতেই ধুলা উড়তে শুরু করল।
images (7).jpeg

বিশাল একটা তালা ঝুলানো। চাবি কোথায়, রজব জানে না। সর্দার বললঃ ‘ভাঙ্গন লাগবি। গাঁতিডা লিয়ে আসো।‘ রজব এখন সর্দারের হাতের পুতুল। আদেশমাত্র সে গাঁতি নিয়ে এল। সাহেন সর্দার অনেক কসরত করেও ভাঙতে পারল না। রজব বললঃ ‘চাচা, এই তালা চাবিঅলা ছাড়া ভাঙ্গন যাবি নি। দেখছেন, কি তেজ তালার!’

‘তেজ হবি না- সোনার মোহরের পাহরাদার এই তালা! তেজ ত থাকবিই। চাবিঅলা খবর দেওয়া যাবি না। এই সিন্দুকে কি আছে, তা শুধু তুমি আর আমি জানবু। আধাআধি ভাগ হবি বেবাক ধন। আর মানুষে জানালি ভাগ বাড়বি খালি।‘ ঠিক কি কারনে আধেক ভাগ সর্দারকে দিতে হবে, রজব বুঝতে পারে না। কিন্তু কথাটার মধ্যে এমন একটা নিশ্চয়তার জোর আছে, রজব প্রতিবাদ করার কারনও খুঁজে পেল না।

তালা ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে সর্দার এবার সিন্দুক ভাঙ্গায় প্রবৃত্ত হল। অনেক কায়দা কানুন করে অবশেষে আংটার একটা মাথা তেছরা করে তালাটা ফাঁক গলিয়ে বের করে আনল। এতে তালা না ভাঙলেও ডালাটা খোলা গেল। দুজনের বুকই এখন ঢিপঢিপ করছে। রজব কুপিটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সর্দার ডালাটা তুলল। সাথে সাথে ভেতর থেকে একটা পুরাতন আমলের সোঁদা ঘ্রান বেড়িয়ে আসল।

‘বাতিডা আগায়্যা ধরো, কিছু দেহি না যে। কত বছরের অন্ধার ঘাপটি মারি আছে! দেহা যায় কিছু?’ –রজব ধাতানি খেয়ে কুপি এগিয়ে ধরল। দুজনের কৌতুহলী দুই জোড়া চোখ পিটপিট করে চেয়ে আছে, আতিপাতি করে অন্ধকার বাক্সে খুঁজছে গুপ্তধন। অন্ধকার চোখে সয়ে আসলে তারা দেখতে পেল, সিন্দুকের ভিতর আরেকটা বাক্স! তবে কি বাক্সে লুকানো আছে সোনার মোহর? শাহেন সর্দারের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

বাক্সটা বের করে এনেছে। যতটা ওজন হবে ধারনা ছিল, ততটা ভার নয়। যেন ভিতরে কিছুই নেই, এমন হালকা। কিছু না পাওয়ার আশংকায় সর্দারের বুক ধুকপুক করতে শুরু করেছে। রজব বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে অবশেষে জিজ্ঞেস করল, ‘এ কিরাম বাক্স? চারদিকে গোল গোল ফুটা, উপরে টিনের চালার লাহান ছাউনি! ভিতরে কি কিছু আছে?’ সর্দার নিজেও কি জানে ভেতরের খবর- কি আছে এই বাক্সে? কেন যুগ যুগ ধরে আগলে রাখা!

‘খাড়াও, দেখতাছি।‘ উপরে কাঠের চৌচালা ছাউনিটা সরিয়ে ভেতরে হাতরায় শাহেন সর্দার। নাহ, কোন ঘড়া কিংবা মোহরের থলে হাতে ঠেকে না। আতিপাতি করে খোঁজে। শুধু কয়েকটা কাগজ হাতে ঠেকে। বের করে আনে কাগজগুলো। একেবারে কাঁচা হাতের আঁকা কয়েকটা ছবি। তেলরঙে আঁকা ছবিগুলো একটার সাথে একটা সুঁই-সুতোয় সেলাই করা। আজব! এই কয়েকটা ছেলেমানুষী ছবি এতকাল আগলে রেখেছে নেজাত! আর সবাই তার আগলানোর যত্নাত্তি দেখে গুপ্তধন ঠাওর করে বসে আছে। কি নির্মম রসিকতা! মনটা বিষিয়ে উঠলো শাহেন সর্দারের। ছবিগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল রাগে।
images (8).jpeg

‘পাগল, তোমার বাপ নেজাত একটা ঠান্ডা মাথার পাগল ছিল। পাগল না হলি কেউ কয়েকটা রঙছবি এরাম যতন করি তুলি রাখে? পাগল না হলি কেউ বাড়ির ভিটায় বটগাছ রাখে? এত এত করি কলাম, গাছটা কাটিয়া কিছু ফলের গাছ লাগাও। কথা কানেই তুললো না। উনি বটগাছ পালবে, কখনো শুনিছ ভিটাবাড়িত কেউ বটগাছ পালে? কও শুনিছ?’

রজব বুঝতে পারে মোহর না পেয়ে সর্দারের মেজাজ গরম হয়ে আছে, তবে তার কথা একেবারে মিছা না। উত্তরের ভিটায় আস্ত একটা বটগাছ পুরো জমিনখানা দখল করে আছে। বটগাছের আশেপাশে অন্য কোন গাছ খুব একটা বাড়ে না। অনেকেই রজবের বাবাকে পরামর্শ দিত, বটগাছটা কেটে জমিনটা কাজে লাগাতে। কারো কথা নেজাতুল্লা কানে তুলত না।

সে কি তবে জানত, এই বটগাছের ছায়ায় তার শেষ মুহূর্তগুলো কাটবে?

০২.

সদর হাসপাতালে গড়ে ওঠা নতুন চকচকে ভবনটাতে ক্যাম্প গেঁড়েছে আর্মিরা। যুদ্ধের হাওয়া শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকেও সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে। যারা যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বাঁচতে শহর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল গ্রামে, তারা এবার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আল্লাহ-ভগবানকে দিনরাত ডাকতে শুরু করল।

ক্যাম্প স্থাপনের পরে শুরু হল সার্চ অভিযান, সেনাদের ভাষায়- মুক্তিদের সমূলে নিপাত করে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার অভিযান। গ্রামে অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, তবে রাতের আঁধারে যে ক’জন যুবক বর্ডার ডিঙ্গিয়ে ওপারে গিয়ে ট্রেনিং আর সাথে কিছু দোনলা বন্দুক নিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল- তারা শহরের আশেপাশে গা ঢাকা দিয়ে থাকত। পাকিদের ক্যাম্পগুলো তখন পর্যন্ত শহরকেন্দ্রিক। তাই ঝটিকা আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু ছিল শহরের ঘাঁটিগুলো।

গ্রামে অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল হার-হাভাতে মানুষগুলো, তাদের কাছে স্বাধীনতা মানে দু’মুঠো ভাত আর লজ্জা নিবারনের দেহাতি থান কাপড়। রাজনীতি, স্বার্বভৌমত্ব, মুক্তি... শব্দগুলো তাদের কাছে দূর নক্ষত্রের মত ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। আর ছিল শহর থেকে পালিয়ে আসা আধা-শহুরে মানুষগুলো। এরা আতঙ্কে ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত পেরুত না।

এর মাঝে কিছু লোক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠেছিল। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া ঘরপালানো ছেলেগুলোর বাড়িঘর মেজর সাহেবকে দেখিয়ে দিত তারা, মাঝে মাঝে আওয়ামী লীগ করা গ্রামের যুবক কিংবা পৌঢ়দেরকেও ধরিয়ে দিত। বিনিময়ে তারা পিস কমিটিতে বড় বড় পদ পেত। মাথা উঁচা করে গ্রামে চলতে পারত। গ্রামের অন্যদের সমিহ পেত। এ-ই বা কম কী?

একদিন শহর থেকে হটাৎ খবর এল, এই গ্রামের উপর দিয়ে মুক্তিবাহিনী রেলযোগে অস্ত্রের বড় একটি চালান নিয়ে যাবে শহরে। বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা আছে তাদের। পাকসেনারা পিসকমিটি আর আলবদর বাহিনীর কয়েকজনকে নিয়ে লালব্রীজের এই পাড়ে অবস্থান নিল। স্টেশন মাস্টারের কাছে আগেই নির্দেশনা পাঠানো আছে- প্রত্যেকটা রেল এখন থেকে ব্রীজের গোঁড়ায় থামবে।
images (9).jpeg

শুরু হল তল্লাসি। তল্লাসি তো নয়, যেন এক একটা ঝড় বয়ে যায় রেলগুলোর উপর দিয়ে। গেরস্থের পোঁটলার কাপড় চোপড় লন্ডভন্ড করে, ইজ্জত আব্রুর তোয়াক্কা না করে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার দেহ হাতরে কয়েকঘন্টা নাগাদ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির পর রেল্গুলোকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত। দু’দিন নির্বিঘ্নে পার হল। তৃতীয়দিন সকালের রেলটা ব্রীজের এই পাড়ে এসে থেমেছে। যথারীতি চেকিং শুরু হল। পাঁচ কামরার ছোট একটা রেল। আধা ঘন্টায় তল্লাশি শেষ।

তবু মেজর সাহেবের সন্দেহ গেল না। এই গাড়িতে তুলনামূলক যুবকদের আধিক্য তাকে ভাবিয়ে তুলল। নির্দেশ দিলেন ইঞ্জিনরুমে তল্লাশি করতে। সেখানে পাওয়া গেল তিন বস্তা গ্রেনেড, হাতবোমার সরঞ্জাম আর সীসার বুলেট। মারাত্মক ক্ষেপে গেল মেজর সাহেব। রেলের সকল যাত্রীকে নামানো হল, সাড়িবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হল সবাইকে। শিশু, বৃদ্ধ, নারী, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী... কেউ বাদ গেল না। এমনকি রেলের কর্মচারীদেরও লাইনে দাঁড় করিয়ে ফায়ার করা হল, ড্রাইভারকেও। তাদের কারো না কারো সহযোগীতা ছাড়া তো আর তিন তিনটে বস্তা ইঞ্জিনরুমে করে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

images (10).jpeg

প্রায় হাজার খানেক মানুষে ঠাঁশা ছিল রেলগাড়িটা। লাশগুলো সারি বেঁধে পরে আছে ব্রীজের পাশের বটগাছটার নিচে। লাশগুলোর একটা গতি করা দরকার। আশেপাশের কয়েকজন তরুনকে ডেকে আনা হল। বটগাছের নিচেই খোঁড়া হল গর্ত, প্রায় এক পুকুর সমান গর্ত। খুঁড়তে খুঁড়তে বিকেল গড়ালো। লাশগুলো গর্তে ফেলে দেওয়া হল। যে তরুনরা গর্ত খুঁড়েছে, তাদেরকেও ব্রাশ ফায়ার করে গর্তে ফেলে দিল পাকবাহিনী। শুধু বেঁচে গেল নেজাত। সে গিয়ে মেজরের পায়ে পড়ল। বলল, “হুজুর, আমি সাচ্চা পাকিস্তানী। সাচ্চা মুসলিম। আমারে মারবেন না।“

মেজরের পাশে তখন ছিল পিস কমিটির সেক্রেটারী রুহুল কুদ্দুস, সম্পর্কে নেজাতের দুঃসম্পর্কের চাচা হন। তিনিও আধো-উর্দু আধো-বাংলায় সুপারিশ করলেন, ‘মেজর সাব, ইয়ে সাচ্চা আদমি আছে। ইসকো মাফ করদিযে। গর্ত ভরাটের জন্যও তো একজন দরকার।‘

অতএব, নেজাত এ যাত্রায় বেঁচে গেল। পাকবাহিনী দ্রুত চলে গেল ক্যাম্পে, রেলের আরেকজন ড্রাইভার পাঠানোর জন্য তারবার্তা পাঠাতে হবে শহরে। মেজর চলে যাওয়ার পর রুহুল কুদ্দুস বললেন,”নেজাত, আজ তো আরেকটু হইলে গেসিলি। আমি থাকাতে বাঁচন গেছে। জানের সদকা দেওয়া লাগে, নইলে বিপদ পুরাপুরি যায়না। মাথার উপর ঘুরপাক খাইতে থাকে। তোর গাই গরুটা কাল বিহানে পাঠায়্যা দিস।“

images (15).jpeg

নেজাত “যে আচ্ছা” বলে মাথা ঝাঁকালো। গর্তে মাটি দিতে দিতে নেজাত দেখল আলবদরের জোয়ান মরদগুলো রেলে উঠে মালামাল যে যা পারছে লুটে নিচ্ছে, আর পিস কমিটির মুরব্বীরা তা দেখে প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেছে। গর্ত ভরাট হতে হতে সন্ধ্যা নামল। ততক্ষনে সবাই ভেগেছে। শুধু নেজাত আর পাঁচ কামরার রেলগাড়ি পরে আছে ব্রীজের গোঁড়ায়।

বটগাছের পাশেই নেজাতের বাড়ি। সে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য পিছু ঘুরতেই শব্দটা কানে এল। প্রথমে ভাবলো, ভুল শুনেছে। দ্বিতীয়বার যখন একই শব্দ শুনল, তখন আর উপেক্ষা করতে পারল না। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে। শিশুর কান্নার মত, কিন্তু ঠিক কান্নাও নয়। যেন কেউ গোঙ্গাচ্ছে, সেই গোঙ্গানির শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ভৌতিক আবহ তৈরি করেছে এই নিঝুম সন্ধ্যায়।

শব্দ অনুসরন করে নেজাত এগুতে থাকল। বটগাছটার পেছনদিকের শিকড় গোল হয়ে ছোট গর্তমত একটা খাঁজ তৈরী করেছে। সেখানে একটা কাপড়ের পোঁটলি পড়ে আছে। পোঁটলিটার নিচ থেকে শব্দটা আসছে। পোঁটলাটা সরাতেই বিস্মিত নেজাত দেখতে পেল, একটা মানবশিশু!

শিশুটা ছোট্ট খাঁজের মধ্যে এমনভাবে বসানো যে, হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ির জায়গা পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। শিশুটির মুখে কাপড় গোঁজা। তাই চিৎকারগুলো মোটা গোঙ্গানির মত মনে হচ্ছে। নেজাত শিশুটিকে তুলে নিল। মুখ থেকে কাপড়ের দলাটা বের করে আনল। শিশুটি অনেকক্ষন পর হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ির সুযোগ পেয়ে শরীর বাঁকিয়ে চিৎকার করে ক্রন্দন শুরু করল। নেজাত আশেপাশে তাকিয়ে কেউ দেখে ফেলার আগে শিশুটিকে নিয়ে ছুটল বাড়ির পানে।

০৩.

ভোরের আলো রাতের অন্ধকারকে যেন ঝাঁট দিয়ে সড়িয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। রজবের ঘুম ভেঙ্গে পাশ ফিরতেই এক কোনে রাখা ভাঙ্গা সিন্দুকটা নজরে এল। উঠে এসে সিন্দুকটা খুললো। দিনের আলোয় ভেতরের বাক্সটা চিনতে তার অসুবিধা হল না। বায়েস্কোপের বাক্স। তার বাবা একসময় নাকি বায়োস্কোপ দেখাতো। তার জন্মের বহু আগের কথা। বাবার মুখে কত গল্প শুনেছে তার!

images (12).jpeg

সে বাক্সের ভেতরের ছবিগুলো বের করে আনলো। একটার সাথে একটা সেলাই করা। রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে একপাশ থেকে ছবিগুলো দেখতে শুরু করল...

প্রথম ছবিটা একটা হাসপাতাল, সামনে সাইনবোর্ড টাঙ্গানো- ‘আলমডাঙ্গা সদর হাসপাতাল’।

দ্বিতীয় ছবিটায় আর্মি পোষাক পড়া একজন সদর হাসপাতালের সাইনবোর্ডটা খুলে ফেলছে, পাশে আরেকজন আরেকটা সাইনবোর্ড হাতে দাড়িয়ে আছে- যেটাতে ‘পাকিস্তান মিলিটারী ক্যাম্প’ লেখা আছে ইংরেজীতে।

পরের ছবিটাতে একটি রেলগাড়ি দাড়ানো একটি লাল রঙের ব্রীজের সামনে।

তারপরের ছবিতে কয়েকজন আর্মি বন্দুক উঁচিয়ে দাড়িয়ে আছে রেলগাড়িটার সামনে। রজব একটার পর একটা ছবি দেখছে আর ঘটনার সূত্রগুলো কল্পনায় মেলাচ্ছে। যদিও কাঁচা হাতের আঁকা, তবু দৃশ্যগুলো সরল এবং সহজবোধ্য।

এর পরের ছবিটায় একটা বট গাছের পাশে অনেকগুলো মানুষ সাড়িবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে আছে, আর একটু সামনে থেকে কয়েকজন আর্মি গুলি ছুঁড়তে বন্দুক উঁচিয়ে আছে।

নেজাত হটাৎ চমকে গিয়ে পেছনে তাকাল। বাড়ির সামনের বটগাছটা তার বাবা কিছুতেই কাটতে দেয় নি। বটগাছটা পেড়িয়ে রজবের দৃষ্টি গিয়ে বিঁধল তার পেছনের লালব্রীজটায়। রজবের নিঃশ্বাস ভারী হতে লাগলো।

সে পরের ছবিটা হাতে নিলো। দেখতে পেল- একটি মহিলা বটগাছটার পেছনে লুকিয়ে রাখছে তার শিশুটিকে।

এর পরের ছবিটা দেখে রজবের গায়ের লোম দাড়িয়ে গেল। একজন মিলিটারী আর্মি সেই মহিলার চুলের মুঠো ধরে পা উঁচিয়ে আছে লাথি মারতে।

পরবর্তী ছবিটি দেখে কেন যেন রজবের চোখ ভিজে গেল জলে। ছবিতে মহিলাটি মরে পরে আছে, তার পেছনে আরো কয়েকটি লাশ পরে আছে। তার পেছনে বটগাছ।

পরের ছবিতে রজব দেখতে পেল, কয়েকজন বটগাছটার নিচে গর্ত খুঁড়ছে।

এরপরের দৃশ্যে লাশগুলো গর্তে শোয়ানো, আর চাপ-দাড়িওলা একজন কোদাল দিয়ে গর্ত ভর্তি করছে। কোদাল হাতে কয়েকজন রক্তে রঞ্জিত হয়ে পরে আছে পাশে।

তারপরের ছবিতে চাপ দাড়ির লোকটা হাত জোর করে বসে আছে এক আর্মির সামনে।

পরের তেলরঙে বটগাছটার নিচে একটা শিশু হাত পা ছুঁড়ে কান্না করছে। পাশে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চাপ দাড়িওলা লোকটা।
images (11).jpeg

সর্বশেষ ছবিটায় লোকটার কোলে বাচ্চাটা। বাচ্চাটার মুখে হাসি। পেছনে সূর্য ডুবছে। সূর্যের লালিমা আকাশটা দখল করে ফেলেছে।

রজব দৌড়ে গিয়ে বটগাছটার নিচে মাটিতে আছড়ে পরে চিৎকার করে কান্না শুরু করল।

Sort:  

Hi @tariqul.bibm, your post has been upvoted by @bdcommunity courtesy of @rehan12!


Support us by voting as a Hive Witness and/or by delegating HIVE POWER.

20 HP50 HP100 HP200 HP300 HP500 HP1000 HP

JOIN US ON

শুভ সকাল ভাই
সালাম নিবেন।কি বলে পাঠক হিসেবে আপনার গল্পের সম্মান দিবো আমি জানি নাহ, তবে অনেকদিন পর আমি কারো।লিখা এতোটা শান্তি নিয়ে পড়লাম।যিনি এখনো জীবিত এবং আমি তার পোস্টে কমেন্ট পর্যন্ত করছি।আমি জানিনা কি বলে আপনাকে ধন্যবাদ দিবো এতো সুন্দর একটা কন্টেন্ট শেয়ার করবার জন্য।
সত্যি, সুন্দর ঠান্ডা, পানির মতন সুপেও

এরকম প্রশংসা দেখলে লজ্জা লাগে। আসলেই গল্পটা অনেক সময় দিয়ে এবং পরিশ্রম করে লিখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত লাল ব্রিজ হত্যাকান্ড সম্পর্কে ইমরান মাহফুজের একটি বই পড়েছিলাম‌ তখন থেকেই গল্পটা মাথায় ঘুরছিল। দীর্ঘসময় নিয়ে গল্পটার ধাপে ধাপে লিখেছি। অনেকবার এডিটিং করেছি। আপনার কমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে আমার পরিশ্রম সার্থক। পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ ভাই লিখাটা উপহার হিসেবে আমার মতন পাঠককে দেবার জন্য।

ভাই এক অংশ টা পরলাম সর্দারের না পাওয়ার ক্ষোভ টা ভালোই লাগলো। বাকি গুলো আবার পরবো।