ধর্ষিতার মনস্তত্ত্ব এবং তার সংগ্রাম

in BDCommunity4 years ago

সমাজে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ সমস্যা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিন পর্বের ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেছি। প্রথম পর্বে আমি ধর্ষণের পটভূমি এবং ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকে দ্বিতীয় পর্ব, এখানে আলোচনা করব- ধর্ষিতার মনস্তত্ত্ব এবং তার সংগ্রাম। একটি মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হয়, তখন এবং তার পরবর্তী সময়ে সে যেই মানসিক তীব্র যন্ত্রণা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়, তার স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করব আজকের আলোচনায়..

images (9).jpeg

প্রথমে আমি একটা বিষয় ক্লিয়ার করতে চাই যে, একটি নারী কেন এবং কিভাবে ধর্ষিত হয়? কারণ সমাজে একটা প্রচলিত মিথ অবচেতন মনে আমাদের মাঝে সঞ্চারিত হয়ে আসছে, যেই মেয়েটি ধর্ষিতা হয় তার কিছু না কিছু দোষ থাকে। যেমন, আমরা কখনো কখনো তাদের পোশাক নিয়ে সমালোচনা করি। আবার কখনো তাদের বাইরে ঘোরাঘুরি নিয়ে কটাক্ষ করি। কখনোবা অন্য ছেলের সাথে বেশি ঘোরাঘুরি কিংবা প্রশ্রয় দেয়ার বিষয়ে খোঁচা দেই।

আমি বলছি না যে আকর্ষণীয় পোশাক, অপ্রয়োজনে রাতে বাইরে থাকা কিংবা সে দুষ্ট ছেলেদেরকে প্রশ্রয় দেয়া.. এগুলো কোন ভাল কাজ। সামাজিকভাবে এগুলো বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। এমনকি কখনো কখনো একজন ধর্ষককে অনুপ্রাণিতও করে, আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমার আপত্তি হচ্ছে- একটা নারীর যখন ধর্ষণের শিকার হয়, আমরা নিশ্চিতভাবে না জানা পর্যন্ত ওই মেয়েটিকে এই খোঁচা দেয়া অবশ্যই মারাত্মক গর্হিত কাজ।

যখন কেউ ধর্ষণের শিকার হয়, তখন তার শরীর ও মনের উপর দিয়ে যে ধকল যায়, তারপরে আমাদের এই তির্যক সমালোচনা তাকে মানসিকভাবে আরও অসুস্থ করে দেয়। এবং ধর্ষিতার মনোবিক্ষণ করতে গিয়ে জানা গিয়েছে যে, আক্রান্ত মেয়ে যতটা না ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করে, তার চেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে ধর্ষণ পরবর্তী পারিবারিক ও সামাজিক সমালোচনার কারণে।

images (12).jpeg


আপনি একটু ভেবে দেখেন- আজ যদি আপনার মা কিংবা বোন ধর্ষণের শিকার হয়, আপনি কি বলবেন যে- উনি যদি পোশাক আরেকটু শালীনভাবে পড়তো তাহলে ধর্ষণের শিকার হতো না? অথবা বলবেন- উনি ছেলেদের কে প্রশ্রয় দিয়েছে বলেই ছেলেরা তার ক্ষতি করেছে?

আমি জানি, এ কথা আপনি কল্পনাতেও আনতে পারবেন আপনার মা বোনের ক্ষেত্রে। তাহলে অন্য মেয়ের ক্ষেত্রে কেন আপনি নিশ্চিত না হয়ে এই যুক্তিগুলো নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন। এটা কি প্রকারান্তরে ধর্ষককে উৎসাহ দেয়া নয়? তাহলে তো ঐ মেয়ে নয়, আমি বলব- আপনিই বরং ধর্ষককে প্রশ্রয় দিচ্ছেন..!

একটি মেয়ে কখনোই ধর্ষণের শিকার হতে চায় না। কারণ আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং তার স্বভাবসুলভ নারীত্বের কারণে তার মাঝে যে লজ্জার খোলস ছোটবেলা থেকে তৈরি হয়, সেটি তাকে এক ধরনের প্রাকৃতিক সতর্কতার আবরণে ঢেকে রাখে। আপনারা দেখবেন, যখনই দেখে কোন পুরুষ কোন মেয়ের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, মেয়েটি একটু বিব্রত হয়।

একজন নারী হিসেবে আমি আপনাকে হলফ করে বলতে পারি, চরিত্রহীন একটি পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির অর্থ মেয়েরা অবশ্যই বোঝে। কেউ কেউ ভেতরে কুঁকড়ে যায়। কেউ কেউ স্বভাবসুলভ অগ্নিদৃষ্টিতে পুরুষটিকে ঝাঁঝরা করে দেয়। আবার কেউবা এড়িয়ে চলে যায়। মানুষ বিভিন্ন রকম হয়, তাই তাদের বিভিন্ন সিচুয়েশনে আচরণগুলোও ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। এটা স্বাভাবিক।

কিন্তু যে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছে, মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখছে সিচুয়েশনের কারণে, তাকে আপনি কখনো বলতে পারেন না যে সে ওয়েলকাম করছে। আমার খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি- কেউ কেউ বলে, একটি নারী না চাইলে কখনো তাকে কেউ ধর্ষণ করতে পারে না। যারা বলে, তারা এক ধরনের মনোবৈকল্যে আক্রান্ত।

কি অদ্ভুত যুক্তি, তাই না! তার মানে কি আপনি বলতে চান, একটি মানুষ কখনোই খুন হবে না, যদি না সে নিজের চায়? কারণ সে তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাধা দিবে! এটা খুব হাস্যকর যুক্তি। ঠিক আপনাদের যুক্তিটাও তেমনি হাস্যকর। তবু আমরা এসব হাস্যকর যুক্তি খুব জোর গলায় আড্ডা টেবিলে দেই আর দিয়ে দিয়ে আমরা এই নিকৃষ্ট কাজের দায়ভারটাকে ডাইভারসিফাইড করে দেই।

আমরা দায়ভারের কিছু অংশ সমাজের উপর দেই। কিছু অংশ ওই মেয়ের পরিবারের উপর চাপিয়ে দেই। আর কিছু অংশ ওই মেয়ের উপর। অবশিষ্ট সামান্য যতটুকু দায়ভার থাকে তা ধর্ষকের উপর পরে। ফলে এই আংশিক দায়ভার তাকে ঘৃণা করা থেকে বাঁচিয়ে দেয় এবং সামাজিক ভাবে কিছুটা সাপোর্ট দেয়।

images (18).jpeg


একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়ার সময় এবং পরবর্তী সময় তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যায়। কখনও কখনও আমরা আমাদের কল্পনার সর্বোচ্চ সীমানা অতিক্রম করে ফেললে, তখন আমাদের আচরণ কেমন হবে- সেটা বুঝে উঠতে পারি না..। যেটাকে বাংলা ভাষায় বলা হয় কিংকর্তব্যবিমূঢ়

যেমন আপনি যখন খুব বেশি খুশি হবেন, তখন দেখবেন- আপনার হাসিটা অপ্রকৃতস্থ মনে হবে! আপনি যখন খুব বেশি কষ্ট পান, তখন কখনো কখনো কান্না ভুলে স্তব্ধ হয়ে যান।

ঠিক তেমনি ওই মেয়েটি অপ্রত্যাশিত অস্বাভাবিক মানসিক ধাক্কায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। যতটুকু বাধা দেয়া উচিত, অনেক সময় সেটা পারেনা। তার মাঝ থেকে ওই বোধশক্তি তাৎক্ষণিকভাবে হারিয়ে যায়। কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে... সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়।

এর পরে কি হয়? পরবর্তী সময়ের সংগ্রামটা আরো কঠিন.. বেশিরভাগ মেয়ে এই জায়গাতে ভুল করে। আমি ঠিক ভুল বলব না, বরং আপোষ শব্দটা এখানে আরো বেশি মানায়। কারণ অপরাধীর বিচার চাইতে গিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মেয়েটিকে যেতে হবে, সেটি বুঝতে পেরে অনেকেই এই তীব্র অপমান, লজ্জা এবং অপরাধকে নিজের মধ্যে গিলে ফেলে এবং নিজেকে সংকুচিত করে ফেলে।

অনেকেই ঘটনাটিকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কারণ সে জানে, এই সমাজের মানুষ আমরা তাকে সহানুভূতি দেখাতে ভালোবাসি। কিন্তু তাকে সামাজিকভাবে গ্রহণ করতে আমরা এখনও প্রস্তুত হইনি। যখন এরকম কোন নিউজ চ্যানেল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় মাধ্যমে ভাইরাল হয়, আমরা মানববন্ধন করি, বিচার চাই, স্ট্যাটাস দেই, ইভেন্ট খুলি এবং একটা সময় দেশব্যাপী একটা আন্দোলন গড়ে ওঠে।

কিন্তু কয়টা পুরুষ জেনেশুনে সেই মেয়েটিকে বিবাহ করতে প্রস্তুত? কয়টা পরিবার ওই মেয়েটাকে সাপোর্ট দিবে? উত্তর একটাই- দিবে না। সবাই একটু অন্য দৃষ্টিতে তাকাবে, যেন সে অপাংক্তেয়! দোষটা যেন তারই! সে যেন একটা পচা আপেল গাছ! থেকে টুপ করে পড়ে গেছে। আর পোকায় খেয়ে ফেলেছে তার অস্তিত্ব। তাকে ময়লার ঝুড়িতে রাখতে হবে.. এরকম একটা নির্মম এবং নৃশংস মানসিকতা আমরা সভ্য মানুষেরা লালন করি। আমরা কোন অংশে সেই ধর্ষকের চেয়ে কম অপরাধী নই!

আর যারা আপোষ করে না, এই তিক্ত অভিজ্ঞতা স্বাগতম জানিয়ে সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে প্রস্তুত হয়.. তাদেরকে যে ধাপগুলো পার হতে হয়, সেগুলো আরো কঠিন হয়। যেমন- প্রথমে ডাক্তারের রিপোর্ট নিতে হয়। ডাক্তারের রিপোর্ট নিতে গিয়ে যেভাবে তাকে পরীক্ষা করা হয় একজন পুরুষ ডাক্তার দ্বারা, সেটি তার জন্য আরো বেদনাদায়ক হয়ে যায়।

তারপর তাকে অভিযোগ লিখতে হয় থানায় গিয়ে। পুলিশ যে ধরনের প্রশ্ন এবং যে ভঙ্গিতে করে, অনেক সময় সেটা খুবই নোংরামীতে পর্যবসিত হয়। তারপর বিচার চাইতে গিয়ে অন্যান্য সামাজিক অব্যবস্থাপনা তো আছেই।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ধর্ষকরা পলিটিক্যাল সাপোর্ট পেয়ে আক্রান্তের পরিবারের উপর বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিতে থাকে এবং কখনো কখনো তাদের ক্ষতি করে। এর বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হতে থাকে। মেয়েটা একদিকে যেমন সামাজিকভাবে হেয় হয়, অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এসকল কারণেই বেশিরভাগ মেয়ে ধর্ষণের পরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

images (16).jpeg


আজ লেখা আর দীর্ঘায়িত করবো না। লেখাটা লিখতে গিয়ে আমার আঙ্গুল বারবার কেঁপে উঠছে। কিবোর্ডে চাপ দিতে গিয়ে মনে হচ্ছে যেন আমার নিজের হৃদয়ে আঁচড় কাটছি। চোখ ভিজে আসছে জলে। যদিও এরকম অভিজ্ঞতার শিকার কখনো নিজে হই নি, কিন্তু যারা হয়েছে তাদের অবস্থানে যখন নিজেকে কল্পনা করি- তখন মনে হয় মাথার উপরে আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। আর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।

আসুন আমরা ধর্ষিতাদের সামাজিক ভাবে গ্রহন করার জন্য নিজেদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন করি এবং এটাকে সামাজিক সচেতনতা আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে দেই আমাদের চতুর্দিকে।