যখন আমরা কাউকে তার মেধার চরম অপচয় করতে দেখি.. তখন খুব খারাপ লাগে। এরকম মাঝে মাঝে দেখা যায়.. হয়তো খুব প্রচন্ড মেধাবী একজন লেখক.. কিন্তু প্রচুর লিখতে গিয়ে এমন সব কবিতা উপন্যাস রচনা করেছেন.. পড়ে কষ্ট লাগে এবং মায়া লাগে। বাংলা সাহিত্যের এরকম কয়েকজন মেধাবী কিন্তু মেধার অপচয়কারী লেখকের অন্যতম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাগুলো পড়লে.. বিশেষ করে তার উপন্যাসগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। মনে হয় যেন- কিছু তিনি বাম হাতে লিখতেন.. আর কিছু ডান হাতে লিখতেন! কারণ আপনি যদি তার পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলো, সোনালী দুঃখ ইত্যাদি উপন্যাস পড়েন.. আবার তার সঙ্গে মেলাতে যান যাই, হীরকদীপ্তি, মনে আছে মনে থাকবে- এরকম সস্তা উপন্যাস.. তখন মনে হবে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন লেখকের লেখা! আপনি মেলাতে পারবেন না।
এটার অন্যতম কারণ ছিল সুপারিশের লেখা। শুধু উপন্যাসের ক্ষেত্রে নয়.. গল্প-প্রবন্ধ, এমনকি কবিতার ক্ষেত্রেও সুনীলের লেখা দুই ভাগে বিভক্ত। কিছু লেখা পড়ে আমরা অসম্ভব প্রতিভাবান একজন লেখকের মেধার স্বাক্ষর পাই.. আবার কিছু লেখা পড়ে মনে হয় সস্তা বাজারি লেখা.. যাতে না আছে সাহিত্যমান.. না আছে পাঠক ধরে রাখার রসদ উপাদান।
আমি যখনই সুনীলের উপন্যাস পড়েছি.. আমার মনে হয়েছে- তাঁর এই যে দুই ধরনের লেখার স্টাইল, এর পেছনের কারণ কয়েকটি:
প্রথমতঃ আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ মতে- যারা দৈনিক সংবাদপত্রে চাকরি করে.. আবার সাহিত্য রচনা করে.. তাদের লেখায় ওজন কমে যায়। সম্ভবত প্রতিদিন পত্রিকার জন্য প্রচুর লেখা লিখতে লিখতে তাদের কাছে লেখাটা পানির মতো হয়ে যায়। কলম নিয়ে বসলে লিখতে শুরু করে। একজন লেখকের যে চিন্তার গভীরতা, শব্দের বুনন এবং ধীরস্থিরতা দরকার.. তা তারা হারিয়ে ফেলে। ফলে তারা এভারেজ মানের লেখা লিখতে থাকেন। সেটি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো খারাপ হয় না, আবার আহামরি ভালোও হয় না। সুনীলের ক্ষেত্রেও সম্ভবত এটি হয়েছে। বিখ্যাত আনন্দবাজার পত্রিকায় দীর্ঘদিন উচ্চপদে চাকরি করতে গিয়ে তিনি লেখার সেই গাম্ভীর্য হারিয়েছেন। পত্রিকার প্রতিদিনের রিপোর্টের মত গড়পড়তা উপন্যাস লিখে গিয়েছেন অনবরত।
দ্বিতীয়তঃ সুপারিশের লেখা বেশিরভাগ সময় খারাপ হয়। যখন কেউ অল্প সময়ে প্রতি জনপ্রিয় লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান.. তখন তার কাছে এত এত সুপারিশ আসতে থাকে যে.. সকলের মনতুষ্টি করতে গিয়ে নিজের লেখার মান বিসর্জন দিতে হয়। এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই স্বীকার করেছেন যে.. প্রচুর লেখা এমনকি তাঁর বিখ্যাত কবিতা কেউ কথা রাখেনি পর্যন্ত তিনি এক বসায় কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়া সুপারিশের ঠেলায় পড়ে লিখে ফেলেছিলেন! এক্ষেত্রে একশটা লিখলে একটা হয়তো ভালো লেখা হয়... বাকি ৯৯টি হয় সস্তা বাজারি লেখা! সুনীলের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
তৃতীয়ত: সস্তা জনপ্রিয়তায় মানুষের লেখার মান হারিয়ে যায়। যখন কেউ জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটে কিংবা পাঠক বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ বেশি দেয়.. তখন তার স্বকীয়তা থাকে না। কারণ বাজারে যেটা চলে, সে নিজেকে সেদিকেই চালিত করে। সুনীলের ক্ষেত্রে এটি হয়েছে। আমরা যদি তার উপন্যাসগুলো দেখি- বিশেষ করে ছোট উপন্যাস এবং বড় গল্পগুলো.. সেখানে যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে হালকা রোমান্টিক টানাপোড়েন.. এইগুলো তরুণ যুবক সমাজে একটা নাড়া দেয়। তারা এগুলো কিনে একবার দুইবার পড়ে.. এরপর ফেলে দেয়। ফলে বইও প্রচুর বিক্রি হয়। আর এই বই বিক্রির জন্যই সুনীল এই ধারায় সাহিত্য রচনা করে নিজস্ব গভীরতাকে বিসর্জন দিয়েছেন।
চতুর্থত: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমার মনে হয়- বিরতিহীন লিখে যাওয়া। লেখকদের মাঝে মাঝে বিরতি দিতে হয়.. নাইলে তাদের লেখনীতে ক্লান্তি আসে.. এবং সেই ক্লান্তি শব্দগুলি বহন করে চলে। এক সময় ক্লান্তিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়.. ফলে তাদের লেখা থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ঝর্ণার শব্দ পাওয়া যায় না। সুনীলের ক্ষেত্রে সেটি হয়েছে। প্রচুর লিখতে গিয়ে তিনি ঝরঝরে ভাষায় দৈনন্দিন ডায়েরি লেখার মতো লিখে গেছেন.. তাতে কখনো কখনো বিদ্যুৎ ঝলকের মতো গভীর জীবনবোধ চমকে উঠলেও.. আবার সেটা হারিয়ে গেছে তার শব্দের ভীড়ে।
যদিও একজন অসম্ভব প্রতিভাবান লেখক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়.. বিশেষ করে তার নিখিলেশ, কেউ কথা রাখেনি ইত্যাদি কবিতা পড়লে আমরা যে নিবিড় জীবনবোধের সাক্ষাৎকার পাই.. কিংবা প্রথম আলো, পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসগুলো পড়লে যে অসাধারণ কথাশিল্পীর সাথে আমাদের দেখা হয়.. উনার অন্যান্য লেখাগুলোতে গিয়ে সেই পরিচয়টা আমরা হারিয়ে ফেলি। তখন খুব কষ্ট লাগে মেধার অপচয় দেখে।