জীবনানন্দ দাশ, একজন অভিশপ্ত দেবদূত

in BDCommunity4 years ago

বাংলা সাহিত্যে কবি জীবনানন্দ দাশের অবস্থান একজন শাপগ্রস্থ দেবদূতের মতো.. যে কিনা পৃথিবীতে নেমে এসেছিল দেবতার অভিশাপে বিদ্ধ হয়ে।

আমরা যেরকম গ্রিক পুরাণে পড়ি.. একটা দেবদূত.. কোন কারণে একটি দেবতার বিরাগভাজন হয়ে.. দেবদূত পৃথিবীতে নেমে আসে.. তারপরও অনেক কষ্ট সহ্য করে.. পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়.. ঠিক সেরকমই একজন যেন কবি জীবনানন্দ দাশ!

images (3).jpeg
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ

ভুল সময়ে জন্ম হয়েছিল উনার.. যে কারণে সমসাময়িক কবিতা পাঠকেরা তার কবিতা বুঝতে পারতেন না.. তবে ধৈর্য এবং সাধনার প্রতিকৃতি ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ! তাকে কেউ একেবারে বুঝতে পারেনি- কথাটা ঠিক নয়.. একজন চিনেছিলেন.. তিনি বুদ্ধদেব বসু।

সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুকেও অনেক কথা শুনতে হয়েছে এর জন্য.. কেন তিনি জীবনানন্দ দাশকে এত বেশি প্রকাশ করেন.. এত বেশি প্রাধান্য দেন..? সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুও এই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে যে.. অন্যরা কেন জীবনানন্দ দাশের মূল্য বুঝতে পারছে না!

বাংলা সাহিত্যের অসীম সৌভাগ্য যে, কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মের সময় বুদ্ধদেব বসু ছিলেন.. নইলে হয়তো জীবনানন্দ দাস হারিয়ে যেতেন.. আর আমরা পেতাম না আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কাণ্ডারী.. এবং গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেয়া একজন আলোকবর্তিকাকে!

জীবনানন্দ দাস কি ছিল.. সেটা বোঝার আগে আমাদেরকে বুঝতে হবে তার সময়টাকে.. তিরিশের দশক যেটাকে বলে.. সেসময় কবিরা সংগ্রাম করছে আধুনিকতাকে কিভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সাথে খাপ খাইয়ে কবিতার নতুন প্রকৃতি ও গঠন ঠিক করা যায়.. সেটা নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে কবিতা।

এরমধ্যে আবার একটা বড় অংশ রবীন্দ্রনাথ থেকে বের হওয়ার জন্য ছটফট করতে করতেই কাব্যজীবন শেষ করে দিয়েছে.. এ সময় আবির্ভাব হলো পঞ্চপান্ডবের।

পাঁচজন বিশিষ্ট কবি.. যারা বাংলা কবিতাকে দিয়েছে আধুনিকতার লেবাস.. তাদের মধ্যে একটা বিষয় মিল ছিল , সেটা হচ্ছে.. তারা প্রত্যেকেই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে সারা জীবন সাধনা করে গেছেন।

তবে এই সাধনার ফলাফল স্বরূপ যে স্বতন্ত্র ধারা প্রত্যেকে সৃষ্টি করেছেন, তা এখনকার যুগে এসে আমাদের কাছে কতটুকু আবেদন রাখে?

বাস্তবতা হল- পঞ্চপান্ডবের বাকি চারজন ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন.. তাদের অবদানের কথা বাংলা সাহিত্য শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে.. কিন্তু তারা আজ ইতিহাস.. বর্তমান নয়।

images (5).jpeg
কবির নিজস্ব হস্তলিপি

আর জীবনানন্দ দাশ ত্রিশ দশকের একমাত্র কবি.. যিনি এখনো বেশি প্রাসঙ্গিক.. এখনো মানুষ স্বেচ্ছায় তার কবিতা পড়ে.. শুধুমাত্র মনের খোরাক এর জন্য.. পরীক্ষায় পাশ করার জন্য নয়.. কিংবা কোন কঠিন প্রবন্ধ লেখার জন্য নয়.. এবং রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে তিনিই একমাত্র কবি.. যিনি এত বেশি প্রভাব অন্য কবিদের উপর রাখতে পেরেছেন পরবর্তী সময়ে।

তারপরও তার জীবনটা শুধু হতাশাই কেটেছে.. লেখালেখি নিয়ে তার হতাশা ছিল.. তার চিত্রকল্পময় কবিতা মানুষ বোঝে না.. দুর্বোধ্য কবিতা বলে দূরে ঠেলে রাখতো। কিছু গল্প উপন্যাসও তিনি লিখেছিলেন.. সেগুলো ছাপানোর সাহস হয় নি.. কারণ কবিতার পরিণতি দেখে তার মনে হয়েছে, সেগুলো পাত্তা পাবে না।

তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু কবিতা পাঠিয়েছিলেন.. পড়ে কবিগুরু পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, 'চিত্রকল্পময় কবিতা'.. যদিও সমালোচনা করেই কবিগুরু কথাটা বলেছিলেন.. পরবর্তীকালে এই চিত্রকল্পময় কবিতাই বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া কবি জীবনে ছিল ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা.. শিক্ষকতা পেশাটা নিজ থেকে উপভোগ করতেন না.. সম্ভবত পেশাটাও তাকে উপভোগ করত না.. তিনি আসলে একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন.. এই কারণে ক্যারিয়ারে সফল হতে পারেন নি।

এরপর ছিল পারিবারিক অশান্তি.. শোনা যায় কবি-স্ত্রীর সাথে কবির মনোমালিন্য চলত সবসময়.. এত এত হতাশা এবং ব্যর্থতা নিয়ে একটা সময় তিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যান।

images (4).jpeg
স্ত্রীর সাথে কবি জীবনানন্দ

সেটা কি আদৌ দুর্ঘটনা ছিল.. নাকি আত্মহত্যা.. তা আজও জানা যায় নি.. হয়তো কখনোই জানা যাবে না.. জানার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কবির জীবনে তখন যা ঘটছিল.. তাতে আত্মহননের দিকে যাওয়াটা কবির জন্য অস্বাভাবিক ছিল না.. বরং তার লেখাগুলো সেই দিকেই ইঙ্গিত করে।

একটা কবিতায় তিনি লিখেছেন:

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেল তারে
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়াছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ
বধূ শুয়ে ছিলো পাশে, শিশুটিও ছিল
প্রেম ছিল- আশা ছিল- জোছনায়
তবু সে দেখিল কোন ভূত
ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল
লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই বিখ্যাত কবিতাটি পড়লে মনে হয়, কবি যেন জানতেন.. আত্মহত্যা তার অনিবার্য পরিণতি! এটাকেই গল্পের শেষ পৃষ্ঠা বলে ধরে নিয়েছিলেন.. এবং সেটার ইঙ্গিত রেখে গিয়েছিলেন কবিতার লাইনে লাইনে।

জীবনের বেদনা, হতাশা বারবার ফিরে এসেছে তার লেখায়। কখনো কবি নিজেকে একটা চিলের সাথে তুলনা করে লিখেছেন:

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে
ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে..

আবার কখনো লিখেছেন:

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক
চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন
আমারে দুদণ্ড শান্তি
দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

কবি সত্যিই একজন ক্লান্ত প্রাণ ছিলেন.. কিন্তু বনলতা সেন বলে আসলেই কেউ তাকে শান্তি দিয়েছিল কিনা.. তার জীবনে এসেছিল কিনা.. তা আজও জানা যায়নি.. যদিও এটা নিয়ে অনেক রকম মিথ প্রচলিত আছে.. অনেক বইও লেখা হয়েছে.. কেউ বলেছিল বনলতা সেন ছিল তার প্রেমিকা.. কেউ বলেছে- বারবণিতা.. আবার কেউ বলেছে- হাসপাতালের নার্স.. আরো অনেক গল্প উপকথা প্রচলিত আছে.. এটাও চিররহস্য থেকে যাবে বাঙালি পাঠকদের কাছে।

জীবনানন্দেরকে মূলত মানুষ আবিষ্কার করেছে তার মৃত্যুর পরে. এমন কি এখনো আবিষ্কার করে চলেছে প্রতিনিয়ত.. এখনো যখন তার কবিতা পড়ি ঘুম না আসা মধ্যরাতে.. মনে হয় যেন আজকের দিনের জন্যই কবি কবিতাটা লিখেছেন.. হয়তো আরও এক শতাব্দী পরেও মনে হবে..

20200720_001737.jpg

Sort:  

One of my favourite poets

Me too