গ্রামবাংলার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য হল পুঁথিপাঠ। আগের দিনে.. বিশেষ করে শীতকালে.. রাতে মানুষজন জড়ো হত একটা বাড়িতে.. আর একজন সুর করে করে পুঁথি পাঠ করে শুনাতো।
যেহেতু তখন টিভি ইন্টারনেট ছিল না.. তখনকার মানুষের জন্য পুঁথি পাঠই ছিল সেকালের ইউটিউব চ্যানেল.. তারা শুনতো.. আর গল্পগুলো মনের স্ক্রিনে সাজাতো..
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে.. একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে এই পুঁথিসাহিত্য। পুঁথিসাহিত্যের নিজস্ব ছন্দ এবং স্টাইল আছে.. যেটাকে বলা হয় পয়ার। কবিরা পয়ার ছন্দে আবার মাঝে মাঝে ছন্দপতন করতো.. ইচ্ছে করেই.. যেন সুরে বৈচিত্র আসে..এবং গতি পরিবর্তন করে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়।
পুঁথির শুরুতে স্রষ্টা এবং মহামানবদের স্মরণ করা হতো.. সেই সঙ্গে মুরব্বিদের দোয়া ও অনুমতি নিয়ে পাঠ শুরু করা হতো.. মাথা দোলাতে দোলাতে পড়া হত পুঁথির তালে তালে.. মানুষজনও দুলতে শুরু করত.. শীতের কুয়াশা.. গ্রামবাংলার আধো-আলো আধো-অন্ধকারেষ.. একটা বিশেষ আবহ তৈরি করত।
কালের পরিক্রমায় পুঁথিসাহিত্য এখন হারিয়ে গেছে.. কিছু কিছু পুরাতন পুঁথি তালপাতায় লেখা অবস্থায় বিভিন্ন পুরাকীর্তিতে পাওয়া গিয়েছে.. যে গুলো বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কিছু পুঁথি উদ্ধার করে সেগুলোকে সংকলন করেছেন। এছাড়া সর্বশেষ গত শতাব্দীতে কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পুঁথির ছন্দে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন.. সেটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে পুঁথিসাহিত্যের সর্বশেষ প্রচেষ্টা ছিল..
আমি চেষ্টা করেছি কাঁচা হাতে পুঁথিসাহিত্যের একটা নমুনা লিখতে। লিখার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু অন্বেষণ করতে করতে হঠাৎ মনে হল.. আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়েই লিখি। এদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য হাজার বছর ধরে যে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়েছে.. তা সংক্ষেপে একটা পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে তুলে আনতে চেষ্টা করেছি.. পড়ার সময় একটু সুর করে পড়লে আসল মজাটা উপলব্ধি করতে পারবেন বলে আশা করি।
সবুজ স্বপ্নের দেশে
সর্বজনে যারে মান্য করে- প্রভু করতার
আরতি করি হৃদয় ভরি আমি গুনাগার
তারপর নবীর শানে..
তারপর নবীর শানে সসম্মানে সালাম জানাই
মাতা-পিতার ময়মুরুব্বির নির্দেশ যদি পাই
তবে বয়ান করি..
তবে বয়ান করি এদেশেরই দুঃখের ইতিহাস
আপনা মাংসে বৈরী হরিণা, আপনা সর্বনাশ
একদিন গোলা ভরা..
একদিন গোলাভরা শস্য ছিল, গোয়াল ভরা গরু
পুকুর ভরা মৎস্য ছিল, ফল-মূল ভরা তরু
সবুজ স্বপ্নের দেশে..
সবুজ স্বপ্নের দেশে বারবার এসে বিদেশি ডাকাত
ঘরে ঘরে লুন্ঠন করে, দীর্ঘ করে রাত
তবু ভোরের আশায়..
তবু ভোরের আশায় পাখির বাসায় কিচিরমিচির শুনি
পাঠান গেল, মোঘল গেল, আশাতে দিন গুনি
বুঝি সকাল হলো..
বুঝি সকাল হলো, রাত পোহালো, ইংরেজ বসে ঘাড়ে
দুইশ বছর ঘাড়ের উপর তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে
ষড়যন্ত্রী যখন..
ষড়যন্ত্রী যখন মীরের মতন আপনা লোকই হয়
অজস্র দিন অন্যের অধীনে আজব কিছু নয়
মোদের ভাগ্য ভালো..
মোদের ভাগ্য ভালো- জন্ম হলো সবুজ স্বপ্নের দেশে সূর্য.. ক্ষুধি.. তীতুমীরের, মরলো যারা হেসে
শুধু দেশের জন্য..
শুধু দেশের জন্য। আমরা ধন্য তাদের অবদানে
কাটলো রাত্রি মাত্র দুইটি শতকের ব্যবধানে
হায়রে নসিব মন্দ..
হায়রে নসিব মন্দ। তবুও অন্ধকার কাটলো না
মেঘে মেঘে আসমান ঢেকে রৌদ্র ফুটল না
এরপর পাকিস্তানের..
এরপর পাকিস্তানের শাসকদের স্বৈরাচারী রূপ
ভাষার প্রশ্নে ছাত্রগণে থাকলো না আর চুপ
সেই থেকে যাত্রা..
সেই থেকে যাত্রা- ক্ষোভের মাত্রা বাড়লো দিনে দিনে
বলো- কে হায় বাঁচিতে চায় স্বাধীনতা হীনে
সাড়ে নয় মাস ধরে..
সাড়ে নয় মাস ধরে যুদ্ধ করে তিরিশ লক্ষ বীর
হেসে খেলে জীবন দিলে উচ্চ করি শির
দুই লাখ মা-বোনের..
দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে জাতি
অবশেষে দেখলে হেসে সোনালী প্রভাতী
স্বাধীন হল দেশটা..
স্বাধীন হল দেশটা। সকল চেষ্টা সকল আন্দোলন
সকল আবেগ-বীরত্ব-ত্যাগ হয়েছে পূরণ
ইতিহাসই প্রমাণ..
ইতিহাসই প্রমাণ- দেশের সম্মান যখনই কেউ লুটে
চাষা-ভূষা এই বাঙালি জাতিই ফুঁসে ওঠে
আরো একবার জাগো..
আরো একবার জাগো, সকল কার্য হয়নি আজো শেষ
এবার সবাই মিলে গড়তে হবে সবুজ স্বপ্নের দেশ।।