বাঙ্গালী হয়ে ভড়া কাঁঠালের মৌসুমে কাঁঠাল নিয়ে একটা ব্লগ লিখবো না এটা কি হতে পারে! কাঁঠাল আর বাঙ্গালীর মাঝে যে সম্পর্ক, এমন সম্পর্ক পৃথিবীতে যে কোন ফল এবং জাতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া বড়ই দুষ্কর। কাঁঠাল ছাড়া যেমন বাঙ্গালীকে কল্পনা করা শোভা পায় না, ঠিক তেমনি বাঙ্গালী ছাড়া কাঁঠালের জনিপ্রয়তা যাচাই-বাছাই করাটা খুবই দুষ্কর বিষয়। আমি কেন বললাম এই কথাটা জানেন, আপনি ভীন দেশের কোন মানুষকে ছোট্ট একটা কাঁঠাল থেকে সকল কোয়া বেড় করে একটা সুন্দর কাঁচের প্লেটে পরিবেশন করলে, তিনি সেখান থেকে সর্বোচ্চ কাঁঠালের দশটি কোয়া খাবেন, কিন্তু আপনি যদি একজন বাঙ্গালিকে আস্ত বড় একটা কাঁঠাল, তার সামনে রেখে বলেন ভাই এই কাঁঠালটা খোসা ছাড়িয়ে একাই খেতে পারবেন? আমি নিসন্দহে আপনার সাথে বাজি লেগে বলতে পারি কোন বাঙ্গালী এই বিষয়টা না করবে না, খোসা ছাড়িয়ে পুরো কাঁঠালের কোয়া গুলো খেতে না পারলেও সে সহজে ছেড়ে কথা বলবে না। তাই হয়তো বাঙ্গলীদের সবচেয়ে প্রিয় ফল কাঁঠাল এবং কাঁঠালের প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কাঁঠালকে বাংলার জাতীয় ফল হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
পুষ্টি গুনের দিক থেকেও কাঁঠাল অনান্য ফলের তুলনায় অনেক এগিয়ে। কাঁঠালে প্রচুর পরিমান ক্যালরি, ভিটামিন-ই,ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন সি এবং প্রোটিন আছে। নিসন্দেহে কাঁঠাল একটি পুষ্টিকর খাবার। আমাদের দেশে অনেক বাঙ্গালী আছে যারা অতিরিক্ত গরমে কাঁঠাল খেতে চান না, কারন কাঁঠাল খেলে তৎক্ষনাৎ শরীরে প্রচুর পরিমানে শক্তি সঞ্চারিত হয় এবং শরীর ঘামতে শুরু করে, যা অনেকের কাছে অসস্তির কারন। এর থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি কাঁঠালে কি পরিমান পুষ্টগুন আছে। বাঙ্গালী খুব পরিশ্রমী জাতি। বিশেষ করে গ্রাম বাঙ্গলার প্রকৃত বাঙ্গালীরা, তারা যথেষ্ট পরিমান পরিশ্রমের কাজ করতে সক্ষম। যাকে আমরা বলি গাঁধার খাটুনি এবং গাঁধার খাটুনির জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমান শক্তির। তাই গ্রাম বাংলার বাঙ্গালীরা প্রচন্ড গরমের মাঝেও কাঁঠাল খেতে কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করে না।
কাঁঠাল বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। কাঁঠাল গাছের খুব ভালো একটা বৈশিষ্ট্য আছে এই গাছ বালু মাটি ব্যতিত যে কোন বৈশিষ্ট্যের মাটিতে জন্মাতে পারে। তবে মাটির গুনাগুনের উপর ফসল কিছুটা নির্ভর করে। দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ,কাঁকুরে এবং অম্লীয় লাল মাটিকে কাঁঠালের ফলন খুব ভালো হয়। সমুদ্র তীরবর্তী পলি যুক্ত মাটিতে যে সব কাঁঠালের চাষ হয়, সেই সব কাঁঠাল সবচেয়ে বেশি মিষ্ট হয় অপর দিকে অম্লীয় লাল মাঠিতে কাঁঠাল গাছের বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয় এবং কাঁঠালের ফলন ও অত্যাধিক হয়। অম্লীয় লাল মাটিতে যেসব কাঁঠাল চাষ হয় সেসব কাঁঠালের আকার অনান্য গুণাবলীর মাটিতে চাষ করা কাঁঠালের তুলনায় অনেকাংশে বড় হয়।
আমাদের দেশে সাধারনত তিন জাতের কাঁঠাল চাষ করা হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে দোঁ-রসা কাঁঠাল সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়। দোঁ-রসা কাঁঠাল এর মিষ্টি সুগেন্ধর জন্য বিখ্যাত। এ জাতের কাঁঠাল পাঁকলে আশে পাশে এর মিষ্টি সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, যা সবাইকে খুব লোভনীয় করে তোলে। এ জাতের কাঁঠালের কোয়ার উপরের অংশ নরম এবং নীচের অংশ হালকা মচমচে হয় হয়ে থাকে, হালকা মিষ্টি হওয়ার কারনে বাংলার অধিকাংশ মানুষ এই জাতের কাঁঠাল খুব পছন্দ করে। এ জাতের কাঁঠাল আকারে খুব বেশী বড় হয় না। গালা-কাঁঠালঃ এ জাতের কাঁঠালের কোয়া গুলো খুব নরম হয়। চিবয়ে খাওয়া খুবই কষ্টকর, চুষে অথবা সরাসরি গিলে খেতে হয়। গ্রামে কিংবা শহরে বাঙ্গালীরা এ জাতের কাঁঠাল দিয়ে চিড়াঁ খেতে খুবই ভালোবাসে। আরেক জাতের কাঁঠাল আছে যাকে আমরা সাধারনত খাঁজা কাঁঠাল বলে থাকি। কারন এই জাতের কাঁঠালের নির্দিষ্ট কোন আকৃতি থাকে না, কাঁঠালের গায়ে এক বা একাধিক খাঁজ থাকে। এ জাতীয় কাঁঠালের কোষ গুলো চমৎকার মচমচে হয়ে থাকে এবং হালকা মিষ্টি হয়ে থাকে। এ জাতের কাঁঠাল অন্য জাতের কাঁঠালের তুলনায় যে কোন ব্যক্তি সংখ্যায় বেশি কোয়া খেতে পারবে। সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হচ্ছে এই তিন জাতের কাঁঠালেই আমাদের দেশে যে কোন মাটির গুনাগুনেই চাষ করা যায়।
যেহেতু অম্লীয় লালচে মাটিতে আমাদের দেশে কাঁঠালের সবচেয়ে বেশী উৎপাদন হয়, তাই ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা গাজীপুরে প্রচুর পরিমানে কাঁঠালের চাষ হয়। যদিও বা ময়মনসিংহ জেলা কাঁঠাল চাষের জন্য বিখ্যাত, এর তুলনায় গাজীপুর জেলায় কোন অংশেই কাঁঠালের উৎপাদন কম হয় না। গাজীপুর জেলার মাটি অম্লীয় এবং লালচে হবার কারনে অত্র জেলার সর্বত্র প্রচুর পরিমানে কাঁঠালের চাষ হয় এবং এই জেলায় উৎপাদিত কাঁঠালের অাকার অনান্য এলাকার চেয়ে তুলনামূলক ভাবে বড় হয়ে থাকে। কাঁঠালের মৌসুমে কাঁঠাল অত্র জেলার মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে যায়। গাজীপুর জেলা হতে প্রচুর পরিমানে কাঁঠাল পার্শ্ববর্তী জেলা গুলতে সরবরাহ করা হয়। গাজীপুর প্রাকৃতিক ঐস্বর্গে পরিপূর্ণ একটি শহর, এবং কাঁঠালের গাছ সেই ঐস্বর্গের অন্যতম একটি অতি মূল্যবান সম্পদ।
আমরা বাঙ্গালী ভাই, আমরা পান্থা ভাত দিয়েও কাঁঠাল খেতে পারি। কাঁঠাল খেয়ে কাঁঠালের বীজটাকেও ছাড়ি না আমরা। বীজকে আমরা বীজ বলি না, বিঁচি বলি, এই বিঁচি ভেজেও খাই, আবার ভেজে ভর্তা করেও খাই, মাঝে মাঝে ঘরে রান্নার কোন তরি তরকারি না থাকলে এই কাঁঠালের বিঁচি দিয়ে তরকারি রান্না করেও খাই। কাঁঠালের কোয়া খাবার পর কাঁঠালের ঝালটাকেও আমরা ডাস্টবিনে ফেলে দেই না। কারন আমরা কাঁঠালের কোয়া এবং বিঁচি ভালোবাসি আর আমাদের পালিত গবাদিপশুরা কাঁঠালের ঝাল। আমরা বাঙ্গালিরা কাঁঠালের শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করি, তাই কাঁঠাল জাতি বাঙ্গালির কাছে চির কৃতজ্ঞ।